নিরাপদ মেয়েবেলা আর কত দূর? by নিশাত সুলতানা

দিল্লির একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে আট মাস বয়সী একটি কন্যাশিশুর কান্নায়। শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন করা হয়েছে তার তুলতুলে ছোট্ট শরীরে। শিশুটি জানে না কী তার অপরাধ, কেন তাকে এই নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে! সম্প্রতি পাকিস্তানে ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হয়েছে সাত বছর বয়সী শিশু জয়নাবকে। এই তো কদিন আগে ঢাকার কদমতলীতে পাঁচ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে ষাট বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে।
জানি না, এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন বিশ্বের আরও কত শত শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাদের ভয়ার্ত কান্নায় হয়তো ভারী হয়ে উঠছে আকাশ-বাতাস। কিন্তু আমাদের বিবেক আজ এতটাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যে সেই নিষ্পাপ শিশুগুলোর কান্নাও কোনোভাবেই আমাদের বিবেকের ঘুম ভাঙাতে পারছে না! ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশটিতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১ হাজার শিশু। শুধু দিল্লিতেই প্রতিদিন গড়ে তিনটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যানে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ৫৯৩ জন। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৪৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু সনদে বর্ণিত ঘোষণা অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সের কম সবাই শিশু। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু, যাদের সংখ্যা প্রায় সাত থেকে আট কোটি। এই শিশুদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই কন্যাশিশু। যৌন নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রায় চার কোটি কন্যাশিশুর নিরাপদ শৈশবের নিশ্চয়তা কতটা দেওয়া হচ্ছে বা দেওয়া সম্ভব? সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এ ধরনের নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যার সামান্যই পুলিশের নথিভুক্ত হয়। সেটি বিবেচনায় আনলে ধর্ষণ কিংবা এ জাতীয় নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যার কয়েক গুণ হবে। শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান ধারা বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপত্তাহীন জনপদে পরিণত করে তুলেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হয়েছেন। রাষ্ট্র তাঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়েছে। জানি না এই উপাধি সমাজের বুকে তাঁদের কতটা সম্মানিত করেছে। অনেকের কাছেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অপূরণীয় আত্মত্যাগ আর অপরিসীম ধৈর্য গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি।
এরপরও হয়তো এই বীরাঙ্গনার কিছুটা হলেও স্বস্তি খুঁজে ফেরেন এই ভেবে যে তাঁদের এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচিতি দিতে সাহায্য করেছে আর বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। কিন্তু আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি মাসে যে প্রায় ৫০টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তারা কোথায় কোন স্বস্তি খুঁজে ফিরবে! পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের সময় লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঙালি নারীকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে। যেকোনো যুদ্ধে ধর্ষণ শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার অনন্য একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয় যুগে যুগে। কিন্তু আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে এই যে শকুনের দল রোজ শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে, আমার বিবেচনায় তারা পাকিস্তানি সেনাদের চেয়েও বেশি ভয়াবহ, নির্মম ও নিষ্ঠুর। শিশু ধর্ষণের সঙ্গে নারী ধর্ষণের বিষয়টি যোগ করলে সামগ্রিক যে চিত্রটি ফুটে ওঠে, তা আরও ভয়ংকর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবমতে, ২০১৭ সালে সারা বাংলাদেশে ৮১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় আর ১১ জন ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ২০১৬ সালে এ ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬৫৯টি। একদিকে ধর্ষণের মাত্রা যেমন বেড়েছে দ্রুতগতিতে, অন্যদিকে কচ্ছপগতিতে চলছে ধর্ষণের বিচারপ্রক্রিয়া। শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাত্র ৩২টি শিশু ধর্ষণ মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো সংঘটিত হয়েছিল ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কিংবা তারও আগে। প্রকৃত অপরাধীরা জামিনে ছাড়া পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নতুন নতুন অপরাধের ছক কষছে। ধর্ষণের ক্রমবর্ধমান এই ধারা আর বিলম্বিত বিচারব্যবস্থার এই চিত্র অব্যাহত থাকলে হয়তো চলতি বছর শেষে ধর্ষণের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরও বৃদ্ধি পাবে। লৌহ নির্মিত পোশাকও কন্যাশিশুকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে। ভয় হয়, এত দিনের নারীর সমতা আর ক্ষমতায়নের আন্দোলনকে পায়ে দলে তাদের আবার অবরুদ্ধ করে রাখা হবে কি না চার দেয়ালে। কিন্তু সেখানেও কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে তো? আমরা কি আবার ফিরে যাচ্ছি আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগে?
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
purba_du@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.