বেগম জিয়ার মামলা ও ন্যায়বিচার by অ্যাডভোকেট এম এ করিম

০১. ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় দেয়ার তারিখ ধার্য করেছেন ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত মামলাটির চলমান প্রক্রিয়া রায়ের মাধ্যমে আইনগত Disposal হবে। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের নিরন্তর সংগ্রামরত আপসহীন দেশনেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ মামলা সঙ্গতকারণেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বহুল আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি; তা ছাড়া গণতন্ত্র উদ্ধারের, ভোটের অধিকার, অরাজক পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধারের চিন্তাচেতনা এবং সংগ্রামের সাথে জড়িত সব দেশপ্রেমিক এ রায় নিয়ে চিন্তিত উদ্বিগ্ন। ওই মামলায় প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ও খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনগত যুক্তিতর্কের উপস্থাপনার সব দিক এসেছে। ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারার পর্যায়ে দেশনেত্রী আদালতে ধারাবাহিকভাবে কয়েক দিন আইনগত দিকসহ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উল্লেখসহ ঐতিহাসিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বিজ্ঞ আদালত বেগম জিয়াকে দীর্ঘ সময় মঞ্জুরসহ মনোযোগসহকারে এই মামলার প্রেক্ষাপট, অভিযোগের বিষয়বস্তু এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিষয়ে শ্রবণ করেছেন। এ মামলায় অভিযোগের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে, তিনি ও অন্য আসামিরা সম্মানের সাথে বেকসুর খালাস পাবেন। সে জন্য বলা যায়, রায় নিয়ে দেশবাসীর এত উৎকণ্ঠা থাকলেও খালেদা জিয়ার ইস্পাতদৃঢ় মনোবলে চির ধরেনি।
০২. কিছু দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কনভিকশনের মাধ্যমে হেয় করা হবে না; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদসহ মন্ত্রীরা খালেদা জিয়াকে শিগগিরই জেলে পাঠানো হবে ইত্যাদি অবাঞ্ছিত আগাম উক্তি করে যাচ্ছেন বিচারাধীন মামলার ব্যাপারে। তাতে শঙ্কিত ও সন্দিহান হওয়ার কারণ বিদ্যমান। বিজ্ঞ বিচারক সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে মামলার আইনগত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করে রায় দেবেন বলে দেশবাসীর আশাবাদ। ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৬৭ ধারা মোতাবেক রায় দেয়ার বিধান- 'What Judgement means : A ÔJudgementÕ meeans the expression of the opinion of the court after due consideration of the evidence and all the arguments' ১৯৭০ সালের পাকিস্তান ক্রিমিনাল ল’ জার্নাল ৪১২ পৃষ্ঠায় লাহোর হাইকোর্ট রুলিংয়ে উপস্থাপন করেছেন। এতে স্পষ্টতই বিজ্ঞ বিচারকের মতামতই প্রাধান্য পায়। ৩৮ ডিএলআর (১৮৮৬) আপিলেট ডিভিশন পৃষ্ঠা-৩১১ (৩১২); ৪৪ ডিএলআর হাইকোর্ট ডিভিশন ২২২ পৃষ্ঠা-৫, ডিএলআর এফসি ১০৭, নিউ পৃষ্ঠা-৬৪; ৬ ডিএলআর এফসি ২৮, ডিএলআর-১৯২, ৬ ডিএলআর পৃষ্ঠা-৪২৮-এ রায় সম্পর্কে রুলিং দিয়েছেন : (Benefit of doubt) Court obliged to carefully examine the prosecution case as well as the defence version of the defence put forward on behalf of the accused has a resonable possibility of being true accused entitled to a verdict of benefit of doubt. অবস্থাদৃষ্টে এ মামলার প্রাসঙ্গিক সব দিক benefit of doubt-এ ভরপুর, যার দরুণ বেগম জিয়াসহ আসামিরা আইনগতভাবে বেকসুর খালাস পাওয়ার হকদার বলে প্রতীয়মান এবং বিজ্ঞ আদালতে তার ব্যত্যয় ঘটার কথা নয়।
০৩. খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত উল্লিখিত মামলা এক-এগারোর পর্যায়ে মইন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ সরকারের আমলে মাইনাস টু ফর্মুলার সময়ে সৃষ্ট। তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে প্রায় ১২টি এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা সৃষ্টি করে দুই নেত্রীকে কারাবন্দী করে সংস্কারের নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার স্বপ্নে বিভোর ছিল তারা। সে আমলে অভিযোগ দায়ের না করে জনপ্রিয় দুই নেত্রীকে জেলে পাঠানোর অপবাদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ সাজানো ঘটনার অবতারণা করে দুদককে ব্যবহার করে মামলা করা হলো। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তার বিরুদ্ধে এক-এগারোর সময় দায়েরকৃত মামলাগুলো এবং তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলা পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে নিয়ে সবাইকে মামলায় আনীত অভিযোগ হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।
০৪. এক-এগারোরপর্যায়ে অবৈধ সরকারের আমলে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুদককে ব্যবহার করে দায়ের করা সব মামলার স্বরূপ এবং অভিযোগের ধরন একইপর্যায়ের উদ্দেশ্যমূলক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সৃষ্ট। তাই মূলত মামলাগুলো ডেথ বা মৃতপর্যায়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ছিল খালেদা জিয়ার মামলাগুলো উঠিয়ে নেয়া; কিন্তু সরকারের বৈষম্যের কারণে এবং আইনের বিধান বা আইনের শাসনে সরকারের হস্তক্ষেপে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তায় ধস নামে। তদুপরি আইনবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, ঘুষ, দুর্নীতি, অরাজকতা ইত্যাদি অনেক বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। সারা বিশ্বে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা এত বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী বলে নজির কোথাও পাওয়া যায় না। আপসহীন নেত্রী গণতন্ত্র, ভোটের অধিকারকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলার নামে নজিরবিহীন হয়রানিকে উপেক্ষা করে নিরন্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ। কার্যত ক্ষমতাসীনরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা’ মোতাবেক বিয়োগ করে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে হাঁটছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির নামে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে স্বেচ্ছাচারী শাসনের নজির সৃষ্টি করা হয়েছে। এর অবসান ঘটিয়ে ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার শেষ ভরসাস্থল বেগম খালেদা জিয়া বলেই জনগণ মনে করে। আপসহীন নেতাকে মামলার বেড়াজালে বন্দী রেখে ক্ষমতাসীনেরা শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে চান। তারা মনে করেন, গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার বঞ্চিত জনগণকে যেটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে, এটাই তাদের প্রাপ্য। মনগড়াপ্রক্রিয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো জাতিকে আরেকটি অবৈধ নির্বাচন ‘উপহার’ দিতে পাঁয়তারা চলছে। এটা মাথায় রেখে বিএনপি চেয়ারপারসনকে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের অনেক আগেই জেলে বন্দী করে নীলনকশা বাস্তবায়নের আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র উদ্ধারে সংগ্রামরত দেশপ্রেমিক লড়াকু সৈনিকদের সন্ত্রাসী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এক-এগারোরপর্যায়ে দায়েরকৃত ভিত্তিহীন, আইনগতভাবে অচল এবং সাক্ষ্য প্রমাণে অসাড় মামলার কারণে যেন সুষ্ঠুভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনিশ্চিত না হয়ে যায়। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক সব দিক বিবেচনায় এনে এ মামলায় ন্যায়বিচারের মাধ্যমে রায় প্রদানে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন বলেই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
০৫. বিএনপি চেয়ারপারসন সংশ্লিষ্ট আদালত এবং বিজ্ঞ বিচারকের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল থেকে আইনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত হাজিরা দিয়েছেন। তিনি বিচলিত নন মোটেই। তিনি ন্যায়বিচার পাবেন মর্মে বিশ্বাসী। জনগণ ক্ষমতাসীনদের অন্যায় পদক্ষেপ মেনে নেবে না। দেশবাসীর এটাই নীরব বার্তা।
লেখক : ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.