রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ায় অসঙ্গতি by পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছে রোহিঙ্গা ইস্যু। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে, সীমান্ত অতিক্রম প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এই সংকট প্রতিবেশী চীন, ভারত ও অন্যান্য বড় শক্তিগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপ ও বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতি নিধনের অভিযোগ এনেছে। এক্ষেত্রে কিছু দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে একই সঙ্গে তারা এটা চায় না, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভূখ-ে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলুক।
এ লক্ষ্যেই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সম্পাদিত হয়েছে সাম্প্রতিক চুক্তি। এটি ১৯৯২-৯৩ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারেই করা হয়েছে। ওই সময়ে ভয়াবহ নৃশংসতা থেকে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে।
এই চুক্তিতে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার শর্তগুলো রয়েছে। এতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ ও শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে একটি ধারা রয়েছে। আশা করা হয়, এর অধীনে শিগগিরই শরণার্থী ফেরত পাঠানো শুরু হবে। তবে এক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট সময়সীমা নেই। চুক্তিতে শুধু বলা হয়েছে, প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন হবে দ্রুততম উপায়ে। মিয়ানমার সরকারের একজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ শরণার্থীদের কাগজপত্র বা ডকুমেন্টেশন সম্পন্ন করার পর তা মিয়ানমারের কাছে তা হস্তান্তর শুরুর পরই শুরু হতে পারে প্রত্যাবর্তন।
এটা পরিষ্কার, আন্তর্জাতিক চাপ থেকে লঘু করতে চায় মিয়ানমার এবং তারা তা করতে চায় দ্বিপক্ষীয় পন্থায়। শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর পূর্বশর্ত কি তার বিস্তারিত এখনও নিরুপণ করা হয়নি। এমনকি রোহিঙ্গারা ফেরত যাওয়ার পর তাদের আইনগত মর্যাদা কি হবে সে বিষয়েও কোনো সুস্পষ্ট কথা বলা হয়নি। ফিরে যাওয়ার পর তারা আরো সহিংসতার শিকার হবেন না এ বিষয়ে দেয়া হয়নি কোনো নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি)। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, এ ইস্যুটি (রোহিঙ্গা) আন্তর্জাতিকীকরণ না করা হবে উত্তম। রোহিঙ্গা সংকটে বেইজিং যে তিন দফা ফর্মুলা দিয়েছে তা তাদের নিজেদের স্বার্থেই করা হয়েছে।
আগস্টের শেষের দিকে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ সময় গণধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞসহ নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এর ফলে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচি পড়েছেন আন্তর্জাতিক কড়া চাপের মুখে। সমালোচিত হচ্ছেন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে। তিনিও সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে নোঙর ফেলার চেষ্টা করেছেন।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গাকে ফেরত যেতে দেয়া হবে তাদের সংখ্যা হবে সীমাবদ্ধ। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে বাঙালি হিসেবে দেখা হয়। মনে করা হয় তারা অবৈধ অভিবাসী। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে এই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়নি। তাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে সেখানে ব্যাপক সংখ্যক বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বিরোধিতা রয়েছে। মিয়ানমারের সরকারি মিডিয়া অব্যাহতভাবে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিদের ও আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে (আরসা) ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ হিসেবে বর্ণনা করে যাচ্ছে। সুচিও সতর্কতার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ দেশটিতে ‘আনচেকড’ মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন। তিনি বলছেন, মিয়ানমারে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এসব রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক আদর্শকে লঙ্ঘনকারী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছে মৌলবাদী বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা।
প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে চীন। কিন্তু তাদের পক্ষপাতী আচরণে বাংলাদেশ অসন্তুষ্ট এটা বুঝতে পেরে তারা পরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। মিয়ানমারে চীনের মূল কৌশল হলো বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সুবিধা আদায় করা। রাখাইনের কাইউকপু বন্দর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং পর্যন্ত এরই মধ্যে রয়েছে চীনের গ্যাস ও আলাদা তেলের পাইপলাইন। ওই কাইউকপু বন্দরে একটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও সেখানে একটি মেগা বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় ভারতের বন্ধুপ্রতিম দেশ বাংলাদেশ অসন্তোষ প্রকাশ করে। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকট এতটাই ভয়াবহ হয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত তার প্রাথমিক দোদুল্যমান নীতি পরিবর্তন করেছে। মিয়ানমারে এখনও ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে স্বার্থ রয়েছে চীন ও ভারত উভয়েরই। এটাই ওই সহিংসতায় নিন্দা প্রকাশে ভারতের অনীহার কারণ। তবে দ্রুততার সঙ্গে ভারত তার নীতি পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশের ক্ষোভের বিষয়টি শান্ত করার উপায় খুঁজেছে। পরিবর্তিত নীতির অধীনে ভারত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকেছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে যুক্ত হয়েছে ভারত। ভারতের যেসব বিদ্রোহী গ্রুপ মিয়ানমারের ভিতরে ক্যাম্প গড়েছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের সহযোগিতা প্রয়োজন ভারতের। এ ছাড়া বড় দুটি কানেক্টিভিটি প্রজেক্টের অগ্রগতির জন্য মিয়ানমারের সহযোগিতা প্রয়োজন। ওই দুটি প্রজেক্ট হলোÑ এক. কালাদান মাল্টি-মডাল প্রজেক্ট। এটি রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ের বন্দরকে ভারতে মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। দুই. ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্প। এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ সাফল্যের জন্য এসব প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমারা কোনো অবরোধ বিবেচনায় নেয়নি। সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। এরপরই মাত্র জবাবদিহিতার আলোচনা এসেছে। আলোচনায় এসেছে, মিয়ানমারে ওই নৃশংসতার জন্য দায়ী সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অবরোধের কথা। এ ছাড়া সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেছেন ষষ্ঠ পোপ ফ্রাঁসিস। তিনি এ সফরে রোহিঙ্গা শব্দটি এড়িয়ে গেছেন। কারণ, রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারে কঠোর বিরোধিতা রয়েছে মিয়ানমারে। ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে আসিয়ান সম্মেলন। সেখানে আসিয়ান চেয়ারম্যান যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে উল্লেখ করা হয়নি রোহিঙ্গা ইস্যু। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনেইয়ের সঙ্গে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মধ্যে যে বিভেদ বা ফাটল দেখা দিয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন আসিয়ান। ইসলামিক দেশগুলোর পতাকাবাহী সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) আরো একবার প্রমাণ করলো তারাও এ সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা রাখে না।  রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ দৃশ্যত একেবারে ম্লান। মিয়ানমার বেশির ভাগ শরণার্থীকে ফেরত নেবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই তাদের নতুন শরণার্থী শিবিরে পুনর্বাসন করবে বাংলাদেশ। আশা করা হচ্ছে, কিছু শরণার্থীকে গ্রহণ করে অন্য দেশগুলো এই চাপ কিছুটা কমিয়ে আনবে।
(পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার। অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ‘ডিস্টিঙ্গুইজড ফেলো’। তিনি ওয়েস্ট এশিয়া ইনিশিয়েটিভ, বাংলাদেশ ও আসিয়ানভুক্ত বিভিন্ন ইস্যু দেখাশোনা করেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে যোগ দিয়েছেন অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয় ২৭শে ডিসেম্বর অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফে। এখানে তার অনুবাদ প্রকাশ করা হলো)

No comments

Powered by Blogger.