২০১৭ সালে আমরা কী শিখলাম?

আরেকটি বছর পেরিয়ে আমরা নতুন বছরে পা দেব দেব করছি। মনে মনে ভাবছি, কত দ্রুত সময় কেটে গেল। প্রতিবছরই এটা মনে হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার কথা। নববর্ষের গানের মতো ভাবতে হয়: কোন গ্লানি মুছে দেব এবার? আমার মতে, এ বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো যৌন নিপীড়ন। তার সঙ্গে অবশ্য গ্লানিও জড়িত। পুরুষ মানুষের গ্লানি। এই গ্লানি বহন করতে হয় নারীকেও, যদিও সে আক্রান্ত। তবে এ গ্লানি আমরা যেন না মুছি। তার পরিবর্তে আমরা সেখান থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করি। এ বছর অনেক পুরুষ মানুষের মুখোশ খুলে এসেছে। আমরা জানতে পেরেছি তাঁদের যৌন নিপীড়ন করার যত ঘটনা। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যৌন নিপীড়ন পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে সচরাচর ঘটে, ঘটেছে। কিন্তু সে ঘটনাগুলো আড়াল করাও চলে প্রতিনিয়ত। সে কারণে যৌন নিপীড়নের কথা ভাবলে মানুষ হয়তো ভাবে, এটা সভ্য সমাজে ঘটে না। অথবা ভাবে, এটার কারণ হলো শিক্ষার অভাব। অথবা এসব হয় বস্তিতে, গরিব ঘরে। কিন্তু এই বছর আমরা যাঁদের কথা জেনেছি, তাঁরা অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকা। হলিউড, বলিউড থেকে শুরু করে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, অনেকেই আছেন জনগণের গড়া যৌন নিপীড়নের তালিকায়। এতটাই ভয় পেয়েছেন একশ্রেণির পুরুষেরা যে তাঁরা প্রতিবাদও করছেন। বলছেন, পুরুষদের মানহানি করার প্রচেষ্টা এটা। কিন্তু আমরা যারা এ বিষয় গবেষণা করি, জানি, এ ধরনের কথাবার্তার উদ্দেশ্য হলো আবার নারীদের দোষারোপ করা। যেন তাঁদের নিপীড়িত হওয়ার কারণ তাঁরা নিজেরাই। তবে এটাও বলা প্রয়োজন, যৌন নিপীড়ন শুধু তারকারা করেন, তা নয়; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা এক জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তার মানে সাধারণ মানুষ—গরিব-ধনীনির্বিশেষে যাঁরা আমাদের আশপাশেই আছেন, তাঁদের অনেকেই যৌন নিপীড়ন করছেন। ৮০ শতাংশ নারী যদি বলে থাকেন, তাঁরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, যেমনটি তাঁরা বলেছেন, তাহলে পুরুষদের বড় একটা অংশই এই নিপীড়নের দায়িত্ব বহন করেন।
যৌন নিপীড়ন করার পেছনে কারণ তাহলে কী?
গবেষণায় দেখা গেছে, নানান ধরনের কারণে যৌন নিপীড়ন অনিবার্য, তবে সব কারণের মূল হলো পুরুষতন্ত্র। যে সমাজ পুরুষতন্ত্র দ্বারা শাসিত, সেই সমাজে মেয়েদের স্থান ছেলেদের থেকে নিচে, নারীর স্থান পুরুষদের থেকে নিচে। যাঁদের অবস্থান নিচে ধরা হয়, তাঁরা নিপীড়িত হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। এ রকম সমাজে অনেক (তবে সবাই নন) পুরুষ মানুষ নারীদের নিজের সম্পত্তি মনে করেন। বিয়ে বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে তো কথাই নেই। নিজের সম্পত্তি মনে করেন বলে তাঁরা নারীদের ঠিক মানুষ ভাবতে পারেন না, গরু-ছাগল ভেবে বসেন। তাঁদের মতো না চলাফেরা করলে বা কথা না শুনলে সেটাতে তাঁরা অপমানিত হন। সেখানেই সমস্যা। সেই অপমানবোধ রোধ করতেই অনেকে মারধর করেন, যৌন সহিংসতার আশ্রয় নেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের উচ্চস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করেন। এটা হয়ে ওঠে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার কলকাঠি। আরেকটা কথাও মনে হয়। এ রকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক মানুষ জানেই না যৌন নিপীড়ন কী জিনিস। যেমন ধরুন, অনেকেই ভাবেন, বিবাহিত হলে যৌন নির্যাতনের কথা বলা অবান্তর, কারণ বিবাহিত জীবনে স্বামীর সঙ্গে এটা হতেই পারে না। এই ধারণা শুধু ভুল না, একেবারেই ভুল। বিবাহিত নারীরা শুধু যৌন নিপীড়ন না, নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হন: মানসিক, শারীরিক, আর্থিক। খুব তীব্র হয়ে উঠলে তার খবর হয়, কিন্তু তারপরও মানুষ এটাকে বিবাহিত জীবনের অংশ ভেবে ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়ে থাকলে আরও বেশি করে মেনে নেন। অথচ ছেলেমেয়েরা যে তাদের মা-বাবার সম্পর্ক দেখে সম্পর্ক গঠনের নিয়মাবলি শেখে তা খেয়াল থাকে না। অন্যদিকে, নানা ধরনের সামাজিক ও ব্যক্তিগত চাপের কারণে অনেকেই মেনে নেন অসহনীয় বিবাহিত সম্পর্ক। আর্থিক ও মানসিক নির্ভরতার কারণেও অনেকে থেকে যান সহিংসতাপূর্ণ সম্পর্কের ভেতর। তবে তাঁরা প্রতিবাদ করছেন না মানে এই না যে এ কোনোটাই ঠিক। এ ধরনের নিপীড়ন শুধু বাড়িতে হয় তাও না। কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানেই যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়: যৌন নিপীড়ন কেন এত বিদ্যমান, ব্যাপক?
আমি বলব, এর কারণ হলো সম্মতি গঠন সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট না। এ বিষয়ে আমাদের আইনি ব্যবস্থাও সমস্যাপূর্ণ ভূমিকা রাখে—বিবাহিত সম্পর্কে জবরদস্তি করা বা ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য না করে যে ভয়াবহ ইঙ্গিত তাঁরা দেন, তার প্রতিফলনই বোধ হয় আমরা দেখছি বৈবাহিক যৌন নিপীড়নের বাড়াবাড়ির মধ্যে। এই অস্পষ্টতার কারণে আমরা দেখি মানুষ, বিশেষ করে পুরুষ মানুষ, বোঝে না নারীর ‘না’ মানে কী। কিছু প্রচলিত ধারণা এখানে তুলে ধরলাম:
১. ‘না’ মানে ‘হ্যাঁ’
কেউ কেউ মনে করেন, নারীর ‘না’ মানে ‘হ্যাঁ’। তাঁরা ভাবেন, লজ্জা পেয়ে মেয়েমানুষ যখন ‘না’ বলেন, তখন তাঁরা আসলে ‘হ্যাঁ’ বলতে চান। কিন্তু, না। কখনো না। আপনি, পাঠক, যদি তা মনে করেন, আমি এখনই বলে দিই, আপনার সাহায্য প্রয়োজন। ধর্ষণের অজুহাত হিসেবে এটা বহু ব্যবহৃত উক্তি হতে পারে, তবে কাউকে জবরদস্তি করা কখনোই যৌক্তিক হতে পারে না। এই ভুল ধারণা মাথায় নিয়ে আপন মনে কাউকে ধর্ষণ না করাটাই শ্রেয়।
২. কিছু ‘না’ বলা মানে ‘হ্যাঁ’
অনেকে মনে করেন, চুপ করে থাকা মানেও ‘হ্যাঁ’। তার মানে মেনে নাওয়া। এটাও ভুল ধারণা।
৩. ‘না’ মানে ‘না’
‘না’ মানে ‘না’, সেটা ঠিক। তবে আমাদের এটাও জানা ও ভাবা দরকার যে সবার ‘না’ বলার ক্ষমতা থাকে না। হলিউডের যেসব যৌন নিপীড়নের ঘটনার কথা আমরা জেনেছি, তা আমাদের পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়, যখন প্রভাবশালী একজন যৌন নিপীড়ন করেন, তখন তাঁকে অনেকেই কিছু বলতে পারেন না, তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নিতে পারেন না। তার মানেই কিন্তু এই না যে তাঁদের মত ছিল; বরং এর মানে হলো তাঁদের ‘না’ বলার সাধ্য নেই।
৪. ‘হ্যাঁ’ মানে ‘হ্যাঁ’
যেকোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর জন্য দুটো মানুষের মত লাগে। তার মানে দুজনেরই ‘হ্যাঁ’ বলা চাই। তবে আবার আমাদের মনে রাখতে হবে, যেহেতু সবার ‘না’ বলার ক্ষমতা নেই, বিশেষ করে যখন নিপীড়ক হন প্রভাবশালী কেউ, অনেকেই হয়তো ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া কোনো উপায় দেখেন না। এই কারণেই শুধু মুখের কথা নয়, আকার-ইঙ্গিতে নারী কী বলছেন, সেটাও যাচাই করা প্রয়োজন। মিডিয়া ও টেলিভিশনে যে হিংস্র ধর্ষণ দেখানো হয়, বাস্তবের সঙ্গে তা হয়তো অনেক সময় মেলে না। অনেকেই মানসিক চাপের মাধ্যমে জোর খাটিয়ে যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন, যা আসলে নিপীড়ন। নারী যে পোশাকই পরে থাকুন না কেন, যেহেতু ধর্ষণ এবং জোর খাটানো থেকে বিরত থাকা ভীষণ জরুরি, সেহেতু নারীর ‘না’ বিষয়ে সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করা দরকার বলেই মনে করি। আর শেষমেশ মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু ‘হ্যাঁ’ মানেই ‘হ্যাঁ’।
নাদিন শান্তা মুরশিদ: সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফালো।

No comments

Powered by Blogger.