তুরস্ক রাশিয়া ও ইরানের সমঝোতা কি ফলপ্রসূ হবে?

তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরান গত মাসে (কাজাখস্তানের রাজধানী) আস্তানায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। এই চুক্তি সিরিয়া পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তুরস্কের সিরিয়া নীতিকে আরো বেশি প্রভাবিত করতে পারে। এটাকে এমনভাবে দেখা হচ্ছে যে, রাশিয়া ও ইরানের অভিন্ন অবস্থানের কাছাকাছি আসার জন্য তুরস্ক এক পা এগিয়ে গেলে তারাও সেভাবে এগিয়ে আসবে।  উল্লেখ্য, সিরিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্যই রাশিয়া ও ইরান অভিন্ন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি পরিবর্তনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো উচিত। এই নমনীয়তা প্রদর্শনের জন্য তুরস্ককে অভিনন্দন জানাতে হবে। চুক্তির বিস্তারিত বিষয় অবশ্য এখনো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যতদূর আমরা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে আস্তানা বৈঠকের আগে তিনটি অঞ্চলের (গুটার পূর্বাঞ্চল, হোমসের উত্তরাঞ্চল ও দারা-কুইনিত্রা) সঙ্ঘাত অবসানপ্রক্রিয়া নিয়ে পক্ষগুলো যে সম্মত হয়েছিল, তা কমবেশি সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ অঞ্চল ইদলিব হচ্ছে অত্যন্ত জটিল বিষয়। এর প্রথম কারণ হলো : সব ধরনের বিরোধী যোদ্ধাদের দিয়ে এই অঞ্চলটি পরিপূর্ণ। এটাকে ওই ধরনের একটি অঞ্চল বা এলাকা হিসেবে দেখা হয়। এক বছরেরও বেশি সময় আগে তারা সেখানে জমায়েত হয়েছিল, তাদের সরকারি বাহিনী অবরোধ করে রাখে এবং সরকার তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বোঝাতে সক্ষম হয় এবং তাদের নিরাপদে চলে যাওয়ার সুযোগও দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, ইদলিব তুরস্কসীমান্তে অবস্থিত এবং সেখানে তুর্কি পর্যবেক্ষক মোতায়েন করাটা সিরীয় সরকারের জন্য একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। সত্যিকার অর্থে, আস্তানায় সিরিয়ার সরকারি আলোচকরা অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ডের পর সিরিয়ায় তুরস্কের যেকোনো অতিরিক্ত সামরিক উপস্থিতির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। উল্লেখ্য, তুরস্ক সমর্থিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি অভিযান চালিয়ে সিরীয় ভূখণ্ডের দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে।
তৃতীয়ত, তুর্কি সৈন্যদের সম্ভবত পর্যবেক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। এ ধরনের মিশনে নিরপেক্ষ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তুরস্ক তাদের ‘বাশারবিহীন সিরিয়া’ নীতি পরিবর্তন করেনি। কয়েক মাস আগে আঙ্কারা আসাদবিরোধী সুর একটু নরম করেছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান যে ভাষায় কথা বলেছেন তাতে মনে হয়েছে তুরস্কের জন্য গুরুত্ববহ, আসাদের অপসারণনীতি এখনো বজায় আছে। অধিকন্তু, অতীতে ইদলিবে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত বিরোধী কিছু উপদল তুরস্কের সমর্থন অথবা সহনশীলতায় উপকৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে অল্প কিছু লোক এখনো বেসামরিক কায়দায় তুরস্কে সক্রিয় রয়েছে। গত মাসে গাজিয়ানতেপে সুন্নি ধর্মীয় নেতাদের একটি গ্রুপ ‘সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের’ অধীনে ‘ন্যাশনাল আর্মি’ হিসেবে সংগঠিত হওয়ার জন্য চরমপন্থী নয়- এমন সরকারবিরোধী যোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ইস্তাম্বুলে ‘সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার’ গঠিত হয়। মনে হয় আঙ্কারা ইদলিবে একটি বৃহত্তর ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, যা আস্তানা চুক্তিতে উল্লিখিত অপর তিনটি জোন বা অঞ্চলের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অধিকতর জটিল হবে। ইদলিবে তুরস্ক হয়তো ইউফ্রেটিস শিল্ড অঞ্চলের মতো একটি সামরিক উপস্থিতি দেখতে চাচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইউফ্রেটিস শিল্ড অঞ্চলে তুরস্ক একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার মতোই কাজ করেছে। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর জারাব্লুস, আলবাব, বিজাহ ও কাবাসিনে আঙ্কারা প্রশাসক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ করেছে। স্থানীয় জনগণের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদির তত্ত্বাবধান এবং দায়েশ অথবা পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটের (ওয়াইপিজি) কুর্দি যোদ্ধাদের দ্বারা বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে যেসব বেসামরিক লোক আশ্রয় নিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি এসব প্রশাসক দেখভাল করবেন। ওয়াইপিজি হচ্ছে সিরিয়ার শক্তিশালী কুর্দি রাজনৈতিক দল দ্য ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টির সশস্ত্র শাখা। তুরস্ক ফ্রি সিরিয়ান আর্মির যোদ্ধাদের জন্য ব্যারাক তৈরি করে দিয়েছে। তুর্কি সরকার তাদের বেসামরিক লোকদের বসবাসকারী জেলাগুলো থেকে বের করে এনে অন্য জায়গায় ব্যারাকে থাকার ব্যবস্থা করেছে। তাদের জন্য সার্বক্ষণিক সামরিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কারণে বেসামরিক লোকদের সাথে যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত সঙ্ঘাত এড়িয়ে যাওয়াও সহজ হয়েছে। তুরস্ক ইদলিবে যেসব সেনা পাঠিয়েছে তাদের স্পর্শকাতর কাজ হবে সিরিয়া সরকার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা অথবা তুরস্কের সমর্থনে যে বিরোধী উপদলগুলো উপকৃত হচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা। এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিপুল কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োজন। দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত থেকে মুক্ত করা বা বিরত রাখার অর্থ শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়, এটা হচ্ছে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা। অতি দ্রুত অথবা দেরিতে হলেও ইদলিব সমস্যার একটি সুস্পষ্ট সমাধানে পৌঁছতে হবে। কম চরমপন্থী উপদলের যোদ্ধাদের কি স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে একীভূত করা হবে? বিদেশী যোদ্ধাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে? তাদের কি নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে? আগে সমর্থন দিয়েছে এমন কিছু যোদ্ধাকে কি তুরস্ক গ্রহণ করবে? এক সময় কি তুরস্ক কর্তৃপক্ষ এসব যোদ্ধাকে নিজ দেশের পক্ষ থেকে বিচারের জন্য তাদের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে? বিভিন্ন্ উপদল কি ইদলিবে একে অপরকে হত্যা করা অব্যাহত রাখবে? সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার প্রশ্ন কি এড়ানো যাবে? একই ধরনের আরো অনেক প্রশ্নের এখনো কোনো জবাব নেই। ইদলিবে তুরস্কের বৃহত্তর ভূমিকা পালনের ব্যাপারে রাশিয়া বিরোধিতা করছে না। মনে হয়, তুরস্ক বৃহত্তর ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যা হোক না কেন- হায়াত তাহরির আলশামের মতো চরমপন্থী সংগঠনকে পরাজিত করা একটি বড় কাজ। ওই কাজ একা তুরস্ককে দেয়া হলে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে, তুরস্ক বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়বেহ।
লেখক : তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.