যেভাবে সৌদি আরবে নাজেহাল হয়েছিলেন সাদ হারিরি

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির গত মাসের সৌদি সফরের দ্বিতীয় দিনের কথা। ততক্ষণে তিনি বুঝতে পারলেন যে, কোথায় যেন গড়বড় আছে। এরই মাঝে সকাল সাড়ে ৮টায় সৌদি রাজকীয় দপ্তরে ডাক পড়লো তার। সৌদি আরবের মানসদে ওই সময়কে তাড়াতাড়িই বলতে হবে। হারিরি ভেবেছিলেন, তাকে হয়তো সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে মরুভূমিতে ক্যাম্পিং করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ জন্য তিনি জিন্স আর টি-শার্ট পরেই সেখানে হাজির হন।
কিন্তু তার ঘোর কেটে যেতে সময় লাগে নি। প্রথমে, তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় সেলফোন। সঙ্গে রাখতে দেওয়া হয় মাত্র একজন দেহরক্ষীকে। এমনকি হারিরিকে ধাক্কা দেন, অপমানও করেন সৌদি নিরাপত্তা রক্ষীরা। অসম্মানের ষোলকলা পূর্ণ হলো, যখন আগে থেকে লিখে রাখা একটি পদত্যাগপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয় তার হাতে। সৌদি টেলিভিশনে তাকে এই পদত্যাগপত্র পড়তে বাধ্যও করা হয়।
পদত্যাগ করতে চাপ দেওয়া ও এজন্য ইরানকে দায়ী করতেই তাকে একদিন আগে রিয়াদে আসতে বলা হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এমন ছিল যে, তিনি যেন কোনো স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের নেতা নন। সৌদি আরবের কর্মচারী মাত্র। টেলিভিশনে সরাসরি নিজের পদত্যাগপত্র পড়তে যাওয়ার আগে, তাকে নিজের বাড়িতেও যেতে দেওয়া হয়নি। অগত্যা, দেহরক্ষীকে দিয়ে স্যুট কিনে আনিয়ে তিনি পরে নেন। এরপর পদত্যাগপত্র পড়েন, যা সম্প্রচার করা হয় সৌদি টিভিতে।
পুরো বিষয়টি যত অদ্ভুতই শোনাক না কেন, এটি ছিল সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের একটিমাত্র অধ্যায়। তার কর্মকা-ে শুধু তার নিজ দেশই নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য কেঁপে উঠেছে। দেশে তিনি তার মতো শ’ শ’ প্রিন্স ও ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছেন। ইয়েমেনে যুদ্ধ বাঁধিয়েছেন। প্রতিবেশী কাতারকে অবরুদ্ধ করেছেন। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে হটানোর লক্ষ্যে প্রিন্স মোহাম্মদের দাবার ছকে সাদ হারিরি একটি গুঁটি ছিলেন মাত্র।
এক ডজন পশ্চিমা, লেবানিজ ও আঞ্চলিক কর্মকর্তা এবং হারিরির সহযোগীদের বরাত দিয়ে এই বর্ণনা ছেপেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
এতে আরও বলা হয়, হারিরি পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ামাত্রই বৈরুতে তার স্তম্ভিত সহযোগীরা তার সঙ্গে যোগাযোগের বহু চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। অবশ্য, ওই দিন সন্ধ্যাটা প্রিন্স মোহাম্মদের সঙ্গে মরুভূমিতে ক্যাম্পিং করেই কাটান হারিরি। ওই দিন ও রাত বেশ অবিশ্বাস্য ছিল পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য। রাতে রিয়াদে মিসাইল নিক্ষেপ করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। একই দিন আটক করা হয় শ’ শ’ সৌদি প্রিন্স ও ব্যবসায়ীকে। আর ওদিকে সৌদি আরবে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন হারিরি। পুরো ঘটনাপ্রবাহ এতটাই অদ্ভুত ছিল যে, লেবানন একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
প্রিন্স মোহাম্মদ তার আগেই প্রতিবেশী ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি এখন না পারছেন ফিরে আসতে, না পারছেন থাকতে। পাশাপাশি প্রতিবেশী উপসাগরীয় দেশ কাতারকে অবরুদ্ধ করেন তিনি। কিন্তু বাগে আনার বদলে কাতারকে তিনি ইরানের দিকে আরও ঠেলে দিয়েছেন। এবার তিনি মনোনিবেশ করেছেন আরেক দেশের প্রধানমন্ত্রীকে জোর করে পদত্যাগ করাতে, যাকে কিনা যথেষ্ট আজ্ঞাবহ মনে হচ্ছিল না তার কাছে। প্রিন্স মোহাম্মদের উদ্দেশ্য ছিল একটি বার্তা পাঠানো যে, সময় এসেছে লেবাননে ইরানের ক্ষমতাধর মিত্র হিজবুল্লাহর প্রভাব ঠেকানোর।
প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে যেভাবে পদত্যাগে রাজি করানো হয়েছে, তা হয়তো সৌদি আরবের ক্ষেত্রে খাটে। কিন্তু বিদেশী এক নেতাকে এই পদ্ধতিতে সামলানোর কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিণতিও থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের মতো জটিল পরিবেশ হলে তো আর কথাই নেই। এত জল ঘোলা করে এখন দেখা যাচ্ছে, হারিরি এখনও সেই লেবাননের প্রধানমন্ত্রীই রয়ে গেছেন। তার জনপ্রিয়তাও এখন বেড়ে গেছে। অপরদিকে হিজবুল্লাহ এখন আগের চেয়েও শক্তিশালী।
সৌদি আরবের এমন অবিচক্ষণ কৌশলে দেশটির খুবই ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশগুলো, যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, জর্দান, মিশর ও হারিরির লেবানিজ সুন্নি দলটির বড় অংশ চটেছে। এত কিছুর পর কিছুটা ছাড় হয়তো লেবাননের কাছ থেকে পাবে সৌদি আরব। কিন্তু এজন্য এই ঝড়ঝাপটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল।
পুরো বিষয়টি নিয়ে কোনো কর্মকর্তাই প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হন নি। বিষয়বস্তু অত্যন্ত গোপনীয় বলেই নয় শুধু। হারিরির জন্যও পুরো ঘটনাপ্রবাহ ভীষণ বিব্রতকর। এখনও পুরো গল্পে কিছুটা ফাঁক রয়ে গেছে। কারণ, হারিরি ছাড়া আর কেউই পুর্ণাঙ্গ চিত্র সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত নন। সৌদি আরবে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় অবশেষে নিরাপদে দেশে ফিরেন হারিরি। ফিরেই তিনি নিজের পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর, রিয়াদে মিসাইল নিক্ষেপের জন্য ইরান ও লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ আনে সৌদি আরব। তারপরই দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা শুরু হয় সৌদি প্রিন্স ও ব্যবসায়ীদের। এক সপ্তাহ পর, লেবাননে থাকা নিজ দেশের নাগরিকদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেয় সৌদি আরব। পুরো ঘটনার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেই আরেকটি যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করতে শুরু করেন।
লেবাননে তখন অস্থিরতা চরমে। তবে লেবাননের কর্মকর্তারা এরপর থেকেই মাঠে নেমে পড়েন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, লেবাননের উত্তাল ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরকে অস্থিতিশীল করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এঁটেছে সৌদি আরব। অনেকের আশঙ্কা ছিল, ওই শিবিরকে কেন্দ্র করে বা অন্যত্র হিজবুল্লাহ-বিরোধী মিলিশিয়া গঠনের চেষ্টা করছে সৌদি আরব ও দেশটির মিত্ররা। তবে এ ধরণের কোনো পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে দেখা যায় নি। সৌদি আরব বলছে, এ ধরণের কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
পশ্চিমা ও আরব কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখনও ঠাওরে উঠতে পারছেন না যে, ঠিক কী উদ্দেশ্যে এত ঝড় তুলেছিল সৌদি আরব। তবে কি লেবাননে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা সৃষ্টি করা বা এমনকি যুদ্ধ সৃষ্টির পরিকল্পনা ছিল? এই সম্ভাবনা অনেকেই উড়িয়ে দেন নি। একটি ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, সৌদি আরব চেয়েছিল হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য দলকে নিয়ে গঠিত লেবাননের ঐক্যমতের সরকারের পতন ঘটিয়ে হিজবুল্লাহর প্রভাব হ্রাস করার। কিন্তু এ ধরণের ক্ষিপ্র পররাষ্ট্রনীতির জন্য যে ধরণের গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক দরকার, তা রাতারাতি গড়ে উঠে না বলে মন্তব্য করেছেন আমেরিকার প্রসিদ্ধ থিংকট্যাংক সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রায়ান কাটুলিস। তিনি বলেন, এখন মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জনের প্রতিযোগিতা বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। সৌদি আরব এখানে স্রেফ নিজের পিছিয়ে থাকার ব্যবধান কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার ফল মিশ্র। সৌদি আরবের কৌশলের দুর্বলতা হলো, এতে ভুল চাল চালা ও পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
(অনুবাদ: মাহমুদ ফেরদৌস)

No comments

Powered by Blogger.