মিয়ানমার সেনারা পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করেছে রোহিঙ্গা নারীদের

রোহিঙ্গা নারীদের মিয়ানমারের সেনারা নির্বিচারে ও পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করত। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ধর্ষণের শিকার ২৯ রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকারের পর এক রিপোর্টে এ কথা জানিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাদের নিপীড়নের শিকার এসব রোহিঙ্গা নারী বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। পৃথকভাবে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এপির সাংবাদিক। এসব নারী তাদের নাম জানিয়েছেন এপির কাছে। তবে নিজের অথবা স্বজনদের প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকে তারা কেবল নামের আদ্যাক্ষর প্রকাশের অনুমতি দিয়েছে। এদের প্রত্যেকের বয়স ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার এসব নারী রাখাইন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। এসব নারীর প্রত্যেকের গল্পের ধরন প্রায় একই। এদের ধর্ষকদের প্রত্যেকেই সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত ছিল। এদের অনেকের পোশাকে তারকা ব্যাজ ছিল, আবার কারো পোশাকে তীরের ব্যাজ ছিল। এর মানে হচ্ছে এসব ধর্ষক মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্য। এর আগে জাতিসঙ্ঘ অভিযোগ করেছিল, রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধর্ষণকে ‘সন্ত্রাসের অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। বার্তা সংস্থা এপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। অবশ্য গত মাসে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপোর্টে দাবি করেছিল রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। গত সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে রাখাইন সফরে গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাখাইনের সীমান্ত কল্যাণমন্ত্রী ফোন টিন্ট বলেন, এই নারীরা দাবি করছেনÑ তারা ধর্ষিত হয়েছেন; কিন্তু তাদের শরীরের দিকে তাকান। আপনি কি মনে করেন, ধর্ষিত হওয়ার মতো তাদের শারীরিক আকর্ষণ আছে? চিকিৎসক ও দাতব্য কর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের শিকার নারীদের যে চিত্র তারা পেয়েছেন তাতে বিস্মিত। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের খুব কমসংখ্যকই চিকিৎসার জন্য আসছেন। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ারসের চিকিৎসকেরা আগস্টের পর থেকে কক্সবাজারে ১১৩ জনকে যৌন সহিংসতার চিকিৎসা দিয়েছেন, যাদের এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তবে সবচেয়ে কম বয়সী ধর্ষণের শিকার শিশুর বয়স ৯ বছর। বিশ্বে সবচেয়ে বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করেছে জাতিসঙ্ঘ। দেশটিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নেই, নেই কোনো মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের কক্সবাজারের তৃণভূমিতে জীর্ণশীর্ণ শিবিরে বর্তমানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। ‘এফ’ আদ্যাক্ষরের এক নারী জানিয়েছেন, এক মাস আগে তার বিয়ে হয়েছিল।
তার স্বামীর বাড়িতে হামলার আগের দিন তিনি জানতে পারেন সেনারা তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে ও ভাইয়েরা নিখোঁজ রয়েছে। ওই রাতে সাত সেনা তার স্বামীর ঘরে হামলা চালায়। তারা ওই নারীর স্বামীকে বেঁধে ফেলে এবং মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়। সেনারা যখন তাকে ধর্ষণ করছিল তার স্বামী মুখের বাঁধন আলগা করে চিৎকার করতে শুরু করলে তার বুকে গুলি করে এক সেনা। এ সময় আরেক সেনা তার স্বামীর জিহ্বা কেটে দেয়। সাত সেনা ধর্ষণের পর তাকে ঘরের বাইরে ফেলে রেখে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ওই নারী এক প্রতিবেশী মহিলার বাড়িতে আশ্রয় নেন। তিন মাস পর পাঁচ সেনা ওই বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রতিবেশীর সন্তান ও তার স্বামীকে হত্যা করে। এ সময় তারা ওই প্রতিবেশী মহিলা ও তাকে ধর্ষণ করে চলে যায়। ধর্ষণ ও হামলার ব্যাপারে অন্য নারীদের দেয়া তথ্যও বর্ণনার সাথে এফের বর্ণনা প্রায় একই। কয়েক জন বলেছেন, নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা গ্রাম ঘিরে ফেলে, পুরুষদের থেকে নারীদের আলাদা করে। পরে অন্য কোনো স্থানে নিয়ে গণধর্ষণ করে নারীদের। এই নারীরা বলছেন, তাদের চোখের সামনেই স্বামীকে পিটিয়ে ও গুলি করে এবং সন্তানদের গলা কেটে হত্যা করতে দেখেছেন। রাতের আঁধারে প্রিয়জনদের মাটিচাপা দিয়েছেন, এমনকি অনেকের লাশ সেখানে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা ধর্ষণের নিদারুণ ব্যথার কথা বলছেন, রক্তপাত নিয়েই বাংলাদেশে এসেছেন দীর্ঘ পথ পায়ে মাড়িয়ে। ধর্ষণ থেকে বেঁচে এসেছেন রোহিঙ্গা নারী ‘এন’। তবে তার স্বামী, দেশ ও শান্তি বলে কোনো কিছুই নেই এখন। তার করারও কিছু নেই। তবে তার আশা, তাদের দুর্দশার কথা হয়তো কেউ শুনবেন। ‘আমার আর কিছুই নেই। এখন বলা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।’ সেনা পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এফের কাছে সন্ধ্যার পর এলেও ‘কে’র কাছে এসেছে দিনের আলোতে। তিনি বলেন, এটা ছিল আগস্টের শেষের দিকের ঘটনা। উত্তর রাখাইনে নিরাপত্তাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পরের ঘটনা। নিরাপত্তাবাহিনী রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাব দিয়েছে নৃশংস উপায়ে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রাখাইনে শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
সূত্র : আলজাজিরা

No comments

Powered by Blogger.