কী চাচ্ছে সরকার

সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে প্রদান করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে সরকার। গতকাল সকালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনটি দায়ের করা হয়। আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরেছে। রিভিউ আবেদন দায়ের করার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল নিজ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে বলেন, আজ আমরা রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছি। এখন শুনানির অপেক্ষায় থাকব। রিভিউ পিটিশনে মোট ৯৪টি গ্রাউন্ড দিয়েছি। এর মধ্যে কিছু গ্রাউন্ড রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে এবং বেশ কয়েকটি গ্রাউন্ড জাতীয় সংসদ আমাদের সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদে ফিরে যেতে চায় কিন্তু এটাকে আদালত অবৈধ করেছেন সেসব বিষয়ে। এটা আদালত অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন না। তিনি বলেন, এ ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হবে কি হবে না তা নির্ভর করবে সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে যখন আইন প্রণয়ন করা হবে তার ওপর। সেই আইনে কী বিধিবিধান থাকবে, তদন্তকাজ কে করবেন, তদন্তকাজের পর রিকমেনডেশন কী হবে এ সংক্রান্ত আইন হওয়ার পরই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বের বিষয়টি আসবে। কাজেই যে আইনই এখনো প্রণয়ন হয়নি সেটি নিয়ে আগে থেকে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কী কী গ্রাউন্ডে আবেদন করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ৩ জুলাই আমাদের যে আপিল খারিজ হয় তা পুনর্বিবেচনা করা এবং আপিলের রায় বাতিল করার আবেদন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতা পুনর্বহালের গ্রাউন্ড আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সংসদের ক্ষমতার কোনো বিষয় নেই। তবে জিয়াউর রহমানের আমলে মার্শাল ল ফরমান দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের নামে যেটা সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল সেটাকে বাতিল করে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদে আমরা ফিরে যেতে চেয়েছি। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে তা আপনারা রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে পুনর্বহাল চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখানে অনেকের ধারণা- সংসদই তাদের অপসারণ করবে। বিষয়টি তা নয়।
যেকোনো বিচারপতি তিনি যদি অসমর্থ হন বা তার বিরুদ্ধে যদি অসদাচরণের কোনো অভিযোগ ওঠে সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে কিভাবে তদন্ত হবে তা ঠিক করা হবে সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। সেই তদন্ত হওয়ার পর তদন্ত কমিটি যদি মনে করে যে তিনি দোষী, সে ক্ষেত্রে তারা রিকমেনডেশন করবে তার অপসারণের জন্য। সেই রিকমেনডেশন পার্লামেন্টে যাবে এবং দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সমর্থিত হলেই তখন সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে চূড়ান্ত আদেশের জন্য। কাজেই তদন্ত কমিটি কোনো বিচারপতিকে যদি দোষী সাব্যস্ত না করেন তাহলে সেটা পার্লামেন্টে যাবেই না।অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মুখ্য বিষয় হলো একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উত্থাপিত হবে, তখন সেটার তদন্ত করার দায়িত্ব কার কাছে থাকবে এবং তদন্তের পদ্ধতিটি কী হবে, তদন্ত কারা করবেন সেটিই হবে মূল বিষয়। এখানে যে পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করা না হয় সে পর্যন্ত তার ব্যাপারে করার কিছুই নেই। রিভিউ আবেদনটি দ্রুত শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ কী উদ্যোগ নেবে- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অবস্থা বুঝে আমরা ব্যবস্থা নেবো। সাবেক প্রধান বিচারপতি যে পর্যবেবেক্ষণ দিয়েছেন সেগুলো কি আপনারা আপনাদের রিভিউ আবেদনে বাতিল চেয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অবশ্যই। তার (সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) পর্যবেক্ষণগুলো সুনির্দিষ্ট করে আমরা আমাদের গ্রাউন্ডে নিয়েছি। আপিল বিভাগের রায়ে বিচারকদের জন্য যে ৩৯টি কোড অব কন্ডাক্ট দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে আমরা বলেছি (রিভিউতে), যারা তদন্ত করবেন তারা ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে কোড অব কন্ডাক্ট নির্ধারণ করবেন। এটা তো রায় দিয়ে করার কথা না। কোড অব কন্ডাক্ট অ্যাপ্রুভ করার কথা রাষ্ট্রপতির। এখানে (রায়ে) তারা যে কোড অব কন্ডাক্ট করেছেন, আমরা বলেছি এটা কোনো ইস্যুই ছিল না তাদের। এটা অনর্থক। নিজেরা নিজেরা করে নিয়েছেন। আমরা এটা বাতিল চেয়েছি। আপিল বিভাগে এখন পাঁচজন বিচারপতি আছেন। ফলে রিভিউ শুনানির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এই উপমহাদেশের যতগুলো মামলা দেখেছি, বিশেষ করে ভারতে যে সাংবিধানিক মামলাগুলো হয়েছে, যে মামলাগুলো পাঁচজন বা সাতজন বিচারপতি করেছেন, সেগুলো যদি উল্টানোর প্রয়োজন হয় বা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হয় তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমানসংখ্যক বা বেশিসংখ্যক বিচারপতিই করেছেন। তবে আমাদের আপিল বিভাগের রুলসে আছে যতখানি সম্ভব করা যায়। আপিলে সর্বসম্মতভাবে রায়টি হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে রায়ের রিভিউ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশাবাদী বলেই তো গত দুই মাস পরিশ্রম করে আমরা রিভিউ পিটিশন তৈরি করেছি। সবচেয়ে বড় গ্রাউন্ড হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানে ছিল, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রধান বিচারপতি এবং তার নিচের দু’জন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা এ বিষয়গুলোর শুনানি করবেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকেও সুযোগ দেয়া হবে আত্মপক্ষ সমর্থনের। আমাদের সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে আছে- এ বিষয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের রেজুলেশন না হলে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না। তিনি আরো বলেন, ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত ৯৬(২) ও (৩) অনুচ্ছেদ বহাল ছিল। কিন্তু অবৈধ সামরিক সরকার আসার পর কোনো প্রতিষ্ঠান বা দল এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই ৯৬ (২), (৩) অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেছে, এমন কথা বলেননি। কাজেই আজকে যখন আমরা মার্শাল ল’ দ্বারা প্রণীত একটি বিধানকে অপসারণ করে সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করতে চাই তখন আদালত কেন এটাকে অবৈধ ঘোষণা করবেন? এ মামলার রিভিউ শুনানিতে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে বাদিপক্ষ বার কাউন্সিলে আবেদন করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়ার করা ওই আবেদনে ভারতীয় আইনজীবী অ্যাডভোকেট আগারওয়াল আমবুজ, অ্যাডভোকেট আগারওয়াল অনামিকা গুপ্তা ও অধিমোলাম ভেঙ্কটারমনের নামও সুপারিশ করা হয়। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বার কাউন্সিলে আন্তর্জাতিক আইনজীবী চেয়ে যারা আবেদন করেছেন, আমার মতে তারা দেশদ্রোহী। তার কারণ দেশের প্রতি আস্থা থাকলে, দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা থাকলে, দেশের বিচারকদের প্রতি আস্থা থাকলে কোনো আইনজীবী এ রকম দরখাস্ত করত পারেন না। উল্লেখ্য, আপিল বিভাগের যে সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরে গেছেন, আর বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করেছেন। ফলে আপিল বেঞ্চে এখন বিচারক আছেন পাঁচজন। গত অক্টোবরের শেষ দিকে অ্যাটর্নি বলেছিলেন, রিভিউ ফাইল করা হলেও নতুন বিচারপতি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত রিভিউ শুনানি করার কোনো সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না। গত ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতভাবে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। গত ১ আগস্ট এ মামলার ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে এই রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানির পর আদালত রুল জারি করে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চান। ওই রুলের ওপর ২০১৫ সালের ২১ মে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী। সংসদে বিচারপতি অপসারণের বিধান একটি দুর্ঘটনা মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.