বড়দিন সামাজিক অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার দিন

‘তাঁহার নাম যিশু (ত্রাণকর্তা) রাখিবে, কারণ তিনি আপন প্রজাদিগকে তাঁহাদের পাপ হইতে ত্রাণ করিবেন’ (মথি ১:২১)। পবিত্র বাইবেলে সদাপ্রভুর দিন অথবা শেষ বিচারের দিন বলে অবধারিত একটি দিন আছে। এই দিনের আগে বড়দিন নামে আরও একটি দিনের জন্ম, কিন্তু কেন? খ্রিস্টানদের বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার এবং নববর্ষ- এই ৪টি উৎসবের মধ্যে বড়দিন সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও আনন্দঘন উৎসব। প্রতিটি উৎসবের পেছনে জড়িত আছে আধ্যাত্মিকতা। যদিও ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ২৫ ডিসেম্বর সবচেয়ে ছোটদিন; কিন্তু খ্রিস্টানদের কাছে দিনটি খুবই বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, কেউ কখনও ঈশ্বরকে দেখেননি। ঈশ্বর যিশুর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ঈশ্বর হয়ে রক্ত-মাংসে মূর্তিমান, পাপে পতিত মানবজাতিকে পরিত্রাণ করতে এই ধরাতে মানুষরূপে প্রকাশিত হলেন (যোহন ১:১-১৪)। যিশুখ্রিস্টের আগমনের জন্য প্রস্তুত ছিল তখনকার পৃথিবী।
রাজনৈতিক অবস্থা : ইহুদিদের বাসস্থান প্যালেস্টাইন ছিল রোম সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমানরা ভাবত, ইহুদিরা একটি একগুঁয়ে ও বিদ্রোহী জাতি, এজন্য রোম সম্রাট তাদের দমন করার জন্য তাদেরই বি-জাতি হেরোদকে তাদের রাজা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এ ব্যবস্থাকে মোটেই পছন্দ করত না ইহুদিরা। তাদের প্রতি কঠোর বিধি-নিষেধের জন্য তারা প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করত। এ ঘোষণার ফলে নেমে আসে তাদের জীবনে চরম দুর্দশা। এত বাধা-বিঘœ ও বিশৃঙ্খলার পরও জগতে তখন স্থাপিত হয়েছিল একতা। এই সন্ধি জুলিয়াসের দ্বারা সম্ভব হয়েছিল। ইহুদি জাতির এ অবস্থা এবং রাজনৈতিক এ সন্ধি যেন খ্রিস্টের আগমনের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল পরিস্থিতি।
অর্থনৈতিক অবস্থা : সেসময়ে বাহ্যিক আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতা আর বিলাসিতার অন্তরালে দারিদ্র্য আর অস্থিরতা গ্রাস করেছিল জাতিকে। রোমে প্রতি তিন লোকের মধ্যে দু’জন ক্রীতদাস ছিল এবং তাদের ব্যবহার করা হতো সম্পত্তির মতো। কোনো কোনো সময় বিদ্রোহও করত তারা। হেরোদের অমিতব্যয়িতা, প্রজাদের ওপরে ধর্মগত ও রাজ্যগত অতিরিক্ত কর ভার, জনসংখ্যাবৃদ্ধি জাতিকে চরম দরিদ্রতায় ফেলে দিয়েছিল। মানুষের জীবন চরম দুর্দশায় ভারাক্রান্ত। জগৎ তখন মানুষের কাছে অত্যন্ত তিক্ত বলে মনে হতো। মানুষ যেন এখান থেকে মুক্তির সন্ধানে কাউকে খুঁজছিল।
ধর্ম ও নৈতিক জীবন : ধর্ম ও নৈতিক জীবনেও ইহুদি জাতির চরম অধঃপতন হয়েছিল। ধর্ম ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পরিহার করে কেবল বাহ্যিক ও মৌখিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা। এ বিষয়ে নবী বলেছিলেন, ‘এই লোকেরা আমার নিকটবর্তী হয় এবং আপন আপন মুখে ও ওষ্ঠাধারে আমার সম্মান করে, কিন্তু আপন আপন অন্তঃকরণ আমা হইতে দূরে রাখিয়াছে (যিশাইয় ২৯ : ১৩)। তখন সৃষ্টি হয়েছিল সমাজে ও ধর্মীয় জীবনে বৈষম্য আর বিভেদ। বিস্তার লাভ করেছিল মিথ্যা, ছলচাতুরী ও ব্যভিচারের মতো জঘন্যতম ব্যাধি। এ বিষয়ে নবী বলেন, ‘দেশের মধ্যে খুব ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। নবীরা মিথ্যা কথা ঘোষণা করে, পুরোহিতেরা নিজের হাতেই ক্ষমতা নিয়ে শাসন করে, আর আমার লোকেরা এই রকমই ভালোবাসে। কিন্তু... শেষে তোমরা কী করবে।’ (যিরমীয় ৫:৩০-৩১)। ‘সকলই বিপদগ্রস্ত হইয়াছে। সৎকর্ম করে এমন কেহই নাই, একজনও নাই’ (গীত ১৪:৩)। ধর্ম সেদিন সমাজের সাধারণ মানুষের জন্য পরিণত হয়েছিল কঠিন বাধা। মানুষ এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় খুঁজছিল।
কালের পূর্ণতা : তিক্ত মানবজাতি যখন মুক্তি পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ, তখন এই উপযুক্ত সময়ে ঈশ্বর তার পুত্রকে এই পৃথিবীতে পাঠালেন, কিন্তু কাল সম্পূর্ণ হইলে ঈশ্বর আপনার নিকট হইতে আপন পুত্রকে প্রেরণ করিলেন, তিনি স্ত্রীজাত, ব্যবস্থার অধীনে জাত হইলেন, যেন তিনি মূল্য দিয়া ব্যবস্থার অধীন লোকদিগকে মুক্ত করেন (গালা ৪:৪)। মানুষের আশা ছিল, যিনি আসবেন তিনি পৃথিবীর রাজনৈতিক নেতার মতো তাদের উদ্ধার করবেন। রাজনৈতিক নেতারাও একই ধারণায় মগ্ন। ইহুদিদের রাজা হিসেবে যিশুখ্রিস্টের জন্মের সংবাদ যখন হেরোদ রাজার কানে পৌঁছল, তখন তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। তার আদেশে সৈন্যরা বেথেলহেমে (যিশুর জন্মস্থানে) দু’বছরের কম বয়সের ছেলে শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করেন। অপরাধ, প্রতিদ্বন্দ্বী আর এক রাজার উত্থান আর সিংহাসন হারানোর ভয়। খ্রিস্টের রাজ্য এই পার্থিব জগতে নয়, তা হেরোদের জানার বাইরে। ধর্ম পুরোহিত ও অধ্যাপকরাও খ্রিস্টের বিরোধিতায় মাতাল হলেন। খ্রিস্টের আগমনে ভণ্ড ও অবৈধ ধর্মীয় অনুশাসনের ক্ষমতা হারানোর ভয় ঘটল, কারণ খ্রিস্টযিশু ঈশ্বরের দেয়া মূল ব্যবস্থাকে সার্বিকভাবে জনসম্মুখে তুলে ধরেছিলেন, যা তাদের গোঁড়ামি, ভণ্ড শিক্ষা, দুর্নীতি ও স্বার্থের ওপর চরমভাবে আঘাত এনেছে। ঈশ্বরের ব্যবস্থা লঙ্ঘন ও বিকৃত করে মানুষ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে চরমভাবে পাপ করেছে। পাপ ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। মানুষ মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।
আর কী করে মানুষ ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসতে পারে? তাই তো ঈশ্বররূপ যিশুখ্রিস্ট স্বয়ং নেমে এসেছিলেন এ পাপময় পৃথিবীতে শুধু মানুষকে বাঁচানোর জন্য। কোনো অস্ত্র, কোনো শক্তি প্রয়োগ করে নয়, যিশু তার স্বর্গীয় ভালোবাসা দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে এসেছেন। তার ক্রুশীয় ভালোবাসা পাপী মানুষকে তার পাপ সম্পর্কে অনুশোচনা, অনুতাপ করতে শেখায় এবং মানুষকে নতুন জীবন দেয়। এ নতুন জীবনই অনন্ত জীবন, যে জীবনের কোনো শেষ নেই। প্রভু যিশুই হচ্ছেন সেই ভালোবাসা। যারা তাকে বিশ্বাস করে তারা পায় অনন্ত জীবন। (যোহন ৩:১৬)। এই জীবন পার্থিব জগতের নয়। স্বর্গীয়, বেহেশতের জীবন। এ ভালোবাসার অন্তরালে যিশু পৃথিবীতে নিশ্চিত করেছেন নারী অধিকার (লুক ২১:১-৪), শিশু অধিকার (মার্ক ১০:১৩-১৬), মানবাধিকার (লুক ১৭:১১-১৯, যোহন ৯:১-৪০)। দূর করেছেন মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ (যোহন ৪:১-৩০)। সুস্থ করেছেন অনেককে। দেখতে পেয়েছে অন্ধজন। হেঁটেছে খঞ্জজন। জীবন পেয়েছে মৃতজন। বড়দিনের তাৎপর্য এখানেই যে, প্রভুদিনের আগে অর্থাৎ শেষ বিচারের আগে বড়দিনের মাধ্যমে প্রভু যিশু মানুষের অন্ধ সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের হাত থেকে ঈশ্বরের মূল ব্যবস্থা ও আজ্ঞাকে মুক্ত করেছেন। ক্রুশীয় মৃত্যু দ্বারা মানুষকে পাপ ও পাপশক্তি থেকে মুক্ত করার বিধান রেখেছেন, যেন প্রভুর শেষ বিচার দিনে মানুষ মুক্তি পায়।
রেভারেন্ড পায়রিন সুটিং : খ্রিস্টধর্মীয় যাজক, সিনিয়র পাস্টর

No comments

Powered by Blogger.