আইয়ুবের টেলিফোন ধরলেন না ইয়াহিয়া

পৃথিবীর সব দেশেই ক্ষমতার অন্দরমহলে অনেক না-বলা কথা থাকে, যা ইতিহাস বা ইতিহাসের কুশীলবদের আত্মজীবনীতে ঠাঁই পায় না। সূচনা থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল অস্থির, অনিশ্চিত ও প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের শিকার। দেশটির প্রথম বড়লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু রহস্যাবৃত—তিনি মারা গেছেন, না তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে খুন হন। ‘বাঙালি’ নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে বড়লাট হন পাঞ্জাবি আমলা গোলাম মোহাম্মদ। তাঁকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন সামরিক আমলা ইস্কান্দার মির্জা। আবার ১৯৫৮ সালের ২৬ অক্টোবর সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান তাঁকে সরিয়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট পদটি দখল করেন। যে কায়দায় আইয়ুব মির্জাকে তাড়িয়েছেন, প্রায় একই কায়দায় ইয়াহিয়া খান তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে জুলফিকার আলী ভুট্টো হন খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভুট্টো—পাকিস্তানের তিন প্রেসিডেন্টের এইড ডি ক্যাম্প বা বিশ্বস্ত সহকারী ছিলেন আরশাদ সামি খান। তাঁর থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান এইড: লাইফ, পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিকস-এ আছে পাকিস্তানের ক্ষমতার অন্দরমহলের কথা। শাসকদের পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও হীনম্মন্যতা কীভাবে দেশটির গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো ধ্বংস করে, কীভাবে তাঁরা সংখ্যাগুরু বাঙালিদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছেন, তারও বর্ণনা আছে এই বইয়ে। প্রেসিডেন্টের বিশ্বস্ত সহকারী বা এডিসির দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিমানবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা আরশাদ সামি খান ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব সিতারাই জুরাত উপাধি পান। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস হলো, তাঁরই পুত্র প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আদনান সামি পাকিস্তান ছেড়ে ভারতকেই দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি তরুণ প্রজন্মের হৃদয় জয় করা এই শিল্পীকে নাগরিকত্ব দেয়। আরশাদ সামি খান ১৯৬৬ সালে আইয়ুবের এডিসি হিসেবে কাজ শুরু করেন। আইয়ুব বিদায় নিলে তিনি ইয়াহিয়ার এডিসি হন। এরপর জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গেও কিছুদিন কাজ করেন তিনি। পরবর্তীকালে আরশাদ সামি দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব ও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেন। আরশাদ সামি খান তাঁর বই শুরু করেছেন আইয়ুবের পতনের ঘটনা দিয়ে। তার আগেই সেনাবাহিনীপ্রধান ইয়াহিয়া খান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, ক্ষমতা দখল করবেন। আইয়ুব যেমন এককাপড়ে ইস্কান্দার মির্জাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন, ইয়াহিয়া খানও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করেন।
উনসত্তরের অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব চেয়েছিলেন পুনরায় সামরিক শাসন জারি করে নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে। যেমন নব্বইয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও পুনরায় সামরিক শাসন জারি করতে চেয়েছিলেন। কেউ সফল হননি। যে সেনাবাহিনীর কাঁধে ভর দিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সেনাবাহিনী তত দিনে তাঁদের ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করেছে। এরশাদের সেই সময়ের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নানা তথ্য আছে মনজুর রশীদ খানের বইয়ে (আমার সৈনিক জীবন, প্রথমা, ২০১৬)। আরশাদ সামি খানের ভাষ্য এবং সেই সময়ের তিন প্রধান কুশীলবের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ধারাবাহিক। জবরদখলকারী কোনো শাসকের বিদায় সুখের ও স্বাভাবিক হয় না। আইয়ুবের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি শেষ পর্যন্ত নিজের ভাগ্য মেনে নিলেন। সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আরশাদ সামি লিখেছেন, ‘আমি করিডর পার হয়ে যেতে ধীরে ধীরে দরজা খুলে দেখলাম, আইয়ুব ও তাঁর স্ত্রী বসে আছেন, নির্বাক। তাঁরা গভীর চিন্তায় মগ্ন। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদ হারানোর আশঙ্কায় তাঁর মনে যে দমকা হাওয়া বইছিল, তার শক্তি বাইরের ঝড়ের চেয়েও অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছিল।’ উল্লেখ্য, ও রকম হতাশাজনক সময়েও তাঁরা ছিলেন পরিপাটি পোশাকে। তাঁদের চুল ছিল পাট পাট করে আঁচড়ানো। পরিষ্কারভাবেই দীর্ঘ দায়িত্ব পালনকালে তাঁরা দেশ-বিদেশের অনেক স্টাইলিশ মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলেন, যা তাঁদের রুচিকে পরিশীলিত করেছে। আমি যখন ভেতরে ঢুকলাম, তখন তাঁদের চোখের ভাষায় বুঝতে পারলাম, তাঁরা একা থাকতে চাইছেন। আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, ‘স্যার, আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে এসেছি, পাঁচ মিনিট পরই আপনার ভাষণ প্রচার করা হবে।’ তিনি বললেন, ‘আমি জানি, আমি জানি, তোমাকে ধন্যবাদ।’
এরপর আইয়ুব তাঁর ভাষণ শুরু করলেন বরাবরের মতো ‘মাই ডিয়ার কান্ট্রিমেন’ বা আমার প্রিয় দেশবাসী বলে। ভাষণের সারকথা ছিল, ‘আমি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। পরিস্থিতি আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রোধ, আতঙ্ক ও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীপ্রধান আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করুন—এটাই গোটা জাতির দাবি।’ আরশাদ সামি জানাচ্ছেন, ভাষণ শেষ না হতেই তাঁর কক্ষের সব টেলিফোন সচল হয়ে উঠল। বিদায়ী সরকারের মন্ত্রীরা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাঁরা কারও সঙ্গে দেখা করলেন না। এরপর আরশাদ সামি ক্ষমতার পালাবদলের যে বর্ণনা দিলেন, তাতে বিদায়ী ও নতুন শাসকের মধ্যকার তিক্ততাই লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছেন, একপর্যায়ে আইয়ুব তাঁকে ইয়াহিয়া খানকে টেলিফোনে ধরিয়ে দিতে বললেন। সামি অফিসে গিয়ে জেনারেল স্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার ইসহাক খানকে আইয়ুবের ইচ্ছার কথা জানালেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান তাঁর অনুরোধ নাকচ করে দিলেন এবং নবনিযুক্ত চিফ অব স্টাফ জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদার সঙ্গে কথা বলতে বললেন। আরশাদ তিন বছর ধরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আছেন। কখনো এ রকম ঘটনা ঘটেনি যে প্রেসিডেন্ট কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চেয়েছেন কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি কথা বলেনি। বরং মন্ত্রী-কর্মকর্তারা তাঁর টেলিফোন পেলে ধন্য হতেন। আরশাদ লিখেছেন, ‘আমি বিষয়টি নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আখতারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। তিনি বললেন, এ ক্ষেত্রে পীরজাদাই হবেন উত্তম বিকল্প। আমি ফিল্ড মার্শালের কাছে গিয়ে বললাম,
জেনারেল ইয়াহিয়া মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। তাঁর বদলে তিনি নবনিযুক্ত চিফ অব স্টাফ পীরজাদার সঙ্গে কথা বলবেন কি না, জানতে চাইলাম।’ আইয়ুব বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করছি না। শুধু জানতে চাইছি ২৫ মার্চ আমি অফিসে যে বিদায়ী নোট রেখে এসেছি, তা তিনি পেয়েছেন কি না। তিনি সেটি পড়েছেন—এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পীরজাদাকে টেলিফোন করে নিশ্চিত হও এবং তাঁকেও পড়তে বলো।’ এরপর আরশাদ সামি জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে সরাসরি টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি সকাল থেকে নানা ঘটনায় ব্যথিত ছিলেন। কিন্তু পীরজাদার কথা নোংরামির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁদের দুজনের কথোপকথন ছিল এ রকম: ‘হ্যাঁ সামি, কী, বলো?’ ‘স্যার, ফিল্ড মার্শাল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্মকর্তা আমাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে বললেন।’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সেটা জানি। দ্রুত বলো যুবক, আমি খুবই ব্যস্ত। ফিল্ড মার্শাল কী চান?’ ‘স্যার, তিনি জানতে চান যে ২৫ মার্চ তিনি অফিসে যে বিদায়ী নোট রেখে গেছেন, সেটি তিনি পেয়েছেন এবং পড়েছেন কি না। তিনি চান, আপনিও এটি পড়ে দেখুন।’ এ পর্যায়ে পীরজাদা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা তা পেয়েছি। তুমি তাঁকে বলো, তিনি যেসব উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো শুনলে তাঁর মতো আমাদেরও পতন ঘটবে। তিনি যদি আমার পরামর্শ চান, বলব, অবিলম্বে তাঁর প্রেসিডেন্ট ভবন ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়া উচিত। অন্তত যেন রাজধানীর বাইরে চলে যান।’ বিদায়ী নোটে আইয়ুব রাজনীতিকদের দাবির প্রতি নমনীয় না হতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি এক ব্যক্তি এক ভোট চালু না করার কথাও বলেছিলেন, তাতে সংখ্যাগুরু পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান শাসন করা সহজ হবে। কিন্তু তত দিনে নতুন জেনারেল ও তাঁর শাগরেদরা নিজস্ব পদ্ধতিতে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
আগামীকাল: আইয়ুবের এক ঘণ্টার বক্তৃতা মোনায়েম খান দুই ঘণ্টা ‘লম্বা’ করলেন
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.