লন্ডনি প্রার্থী নেই, নিরুত্তাপ নির্বাচন

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচন হলেই ‘লন্ডনি’ প্রার্থী থাকেন। তাঁরাই মূলত ভোটের মাঠ গরম রাখেন। কিন্তু এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একজনও লন্ডনি বা প্রবাসী প্রার্থী নেই। ফলে নির্বাচনী মাঠও নিরুত্তাপ। এলাকার লোকজন বলছেন, হঠাৎ করে তফসিল হওয়ায় প্রবাসী প্রার্থীরা এই নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতির সময় পাননি। আর ছয় দিন পর ৬ মার্চ এখানে ভোট। এর মধ্যে জগন্নাথপুর উপজেলা সদর, রানীগঞ্জ, ফাইলগাঁও, মীরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটের আলাপ-আলোচনা খুব একটা দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত উপজেলা সদরে কোনো প্রচার শিবির করেননি বিএনপির প্রার্থী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী দুটি অস্থায়ী প্রচার শিবির খুলেছেন। জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিনজন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে নারী-পুরুষ মিলিয়ে আটজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আকমল হোসেন, বিএনপির প্রার্থী মো. আতাউর রহমান ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মুক্তাদীর আহমদ (প্রতীক-আনারস)। তিন প্রার্থীই প্রথম আলোকে বলেছেন, হঠাৎ করে নির্বাচন দেওয়ায় তাঁরা অনেকটা অপ্রস্তুত।
এর মধ্যে আকমল হোসেন বলেছেন, এ সময় কেউ নির্বাচন আশা করেনি। উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে রানীগঞ্জ বাজার। সেখানকার চা-দোকানি নাছির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জগন্নাথপুরে লন্ডনি প্রার্থী না থাকলে ভোট জমে না। একই কথা বলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক মুজিবুর রহমানও। তিনি বলেন, এই এলাকার যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনেরাও প্রচারে অংশ নেন। কিন্তু এবার হঠাৎ নির্বাচন দেওয়ায় প্রবাসীরা তেমন আসেননি। স্থানীয় লোকজন প্রবাসীদের অনুপস্থিতির পাশাপাশি জগন্নাথপুরে নির্বাচনী উত্তাপ না থাকার পেছনে আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তা হলো কৃষিপ্রধান জগন্নাথপুরের ভোটারদের বড় একটি অংশ এখন ব্যস্ত মৌসুমের বোরো রোপা নিংড়ানোর কাজে। এ ছাড়া এলাকার বৃহৎ হাওর ‘নলুয়ার হাওর’জুড়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। শ্রমিকশ্রেণির মানুষের একটা অংশ ব্যস্ত মাটি কাটায়। এর সঙ্গে আছে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি অংশ অসন্তুষ্ট, তারা নিষ্ক্রিয়। ফাইলগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা রংমিস্ত্রি শাহনূর মিয়ার বক্তব্য একটু ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়া মানুষের ইন্টারেস্ট নাই। প্রার্থীরা আইয়্যা একটা লিফলেট দিয়া কয়, আমার লাইগা দোয়া খরবায়, বালা লাগলে ভোট দিবায়। এরপর আর দেখা নাই।’ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকমল হোসেন উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির সভাপতি। আর বিদ্রোহী প্রার্থী মুক্তাদীর আহমদ নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান। গত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মামলা থাকায় মুক্তাদীর দুই বছর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় মুক্তাদীরকে গত সপ্তাহে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর বিএনপির প্রার্থী আতাউর রহমান হলেন দলের সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাবেক সহসভাপতি। তিনি গত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৩২০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে ভোটে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা বেশি। যদিও এই এলাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত। কিন্তু সুনামগঞ্জ জেলায় আওয়ামী লীগের প্রয়াত দুই নেতা আবদুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুসারী হিসেবে পরিচিত দুটি ধারা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় আছে। পুরোনো সেই বিভেদ জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকমল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলের আরও একজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি আগে ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি কিছু ভোট টানবেন। এরপরও সমস্যা হবে না। আমার অবস্থান ভালো।’ স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের (জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) সাংসদ হলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুসারী ধারার সঙ্গে আছেন। তিনি আকমল হোসেনকে সমর্থন করেন। আর প্রয়াত সামাদ আজাদের অনুসারীরা চেয়েছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হরমুজ আলীকে প্রার্থী করতে।
সেটা না হওয়ায় এ অংশটির নেতা-কর্মীরা এই ভোটে নিষ্ক্রিয় আছেন। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকমল হোসেন (মীরপুর) ও বিএনপির প্রার্থী আতাউর রহমান (সৈয়দপুর শাহারপাড়া) একসময় উপজেলার দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। দুজনই তখন আওয়ামী লীগ করতেন। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি উপজেলা নির্বাচনে আকমল আওয়ামী লীগের সমর্থনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। আর আতাউর বিএনপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ান। আকমল চেয়ারম্যান হন, আতাউর পরাজিত হন। এবার আবার দুজন পুরোনো লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিএনপির প্রার্থী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব প্রার্থীই নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালাচ্ছি। এ কারণে মাঠে হইহুল্লোড় বা নির্বাচনী উত্তেজনা বলতে যা বোঝায়, তা দেখা যাচ্ছে না।’ জগন্নাথপুর উপজেলায় ভোটারসংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৯৯। দেশের অন্যতম প্রবাসী-অধ্যুষিত এই উপজেলার বাসিন্দাদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে থাকেন। তাই জগন্নাথপুরে স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচনে প্রবাসীদের অংশগ্রহণে আলাদা উত্তাপ থাকে। ভোটে বাড়তি ব্যয় গণমাধ্যমের খবরও হয়। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জগন্নাথপুরের আটটি ইউনিয়নের সাতটিতে ভোট হয়। সাত ইউনিয়নে মোট ৩১ প্রার্থীর মধ্যে ১৭ জন ছিলেন প্রবাসী। তাঁদের মধ্যে জয়ী হন ছয়জন। এর আগে জগন্নাথপুর পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তিনজনই প্রবাসী। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে নয়জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর চারজন ছিলেন প্রবাসী। কিন্তু এবার একজনও নেই। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মুক্তাদীর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে নির্বাচন ঘোষণা করায় প্রার্থীদের প্রস্তুতি ছিল না। এ কারণে প্রার্থীর সংখ্যাও কম। তা ছাড়া মানুষ রাজনৈতিকভাবে খুবই বিভক্ত। সব মিলিয়ে অনেকে হয়তো প্রার্থী হওয়ার উৎসাহ পাননি।

No comments

Powered by Blogger.