ছোট ঋণে বড় দুর্নীতি

রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) গণহারে ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১১ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে ব্যাংকের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ শাখা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে অনেক অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানও ঋণ পেয়েছে। বর্তমানে শাখাটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৭৮ শতাংশই খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো নিয়ম অনুসরণ করেননি। উল্টো গুরুতর অনিয়ম ও জালিয়াতি করা হয়। এর ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে শাখাটি হুমকিতে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিতোষণ নীতির কারণে বিডিবিএলের আজকের এ পরিণতি। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এর দায়ভার নিতে হবে। পাশাপাশি জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জানা যায়, ২০১৫ সালের শেষে বিডিবিএলের প্রধান কার্যালয় ও ৬টি বড় শাখার ওপর বিশদ পরিদর্শন পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগের ৬০ দশমিক ৬৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ওই ছয় শাখা। তাতে সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আশুগঞ্জ শাখার ভয়াবহ ঋণ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। আশুগঞ্জ শাখায় ৭৮ শতাংশ খেলাপি ঋণের কথা শুনে চমকে ওঠেন সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। তিনি বলেন, দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে খেলাপির এমন চিত্রের কথা আর শুনিনি। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকের কী হবে। কোথায় যাবে এসব ব্যাংক। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেংকারি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি, বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতিসহ বিগত ১০ বছরে সরকারি ব্যাংকে যত কেলেংকারি হয়েছে, তার একটিরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। সে কারণে এসব অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিডিবিএল সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম হওয়ার সময় আশুগঞ্জ শাখার ঋণ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হারুন অর রশিদ খান। তার যোগসাজশে সব ঋণ দেয়া হয়েছে। অনিয়মের ধরন বর্ণনায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, একজন গ্রাহক ৩ লাখ টাকা ঋণ আবেদন করেন। গ্রাহকের আবেদনপত্রের সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্র সংযোগ করে প্রধান কার্যালয় থেকে মোট ৩০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। পরে গ্রাহকের পকেটে ৩ লাখ টাকা গেলেও হারুন অর রশিদ খানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পকেটে গেছে ২৭ লাখ টাকা। হারুন অর রশিদ খান এখন ব্যাংকের কোনো পদে নেই। তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই হারুন অর রশিদ খানকেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবার ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছে। এ ব্যাপারে হারুন অর রশিদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিডিবিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর আহমদ যুগান্তরকে বলেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখায় ঋণ দেয়া ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ পাওয়া গেছে। এর একটি হল মেসার্স ইশা শিপিং লাইন্স। ২০১৪ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ২০ লাখ টাকার মেয়াদি ঋণ অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল সরেজমিন গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বর্তমানে পুরো ঋণটি আদায় অনিশ্চিতমানের খেলাপি। এর বাইরে ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর মেসার্স আরাফাত ডেইরি ফার্মকে দেয়া হয়েছে ১৫ লাখ টাকার ক্ষুদ্র ঋণ। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক টিম সরেজমিন গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানটিরও অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বর্তমানে পুরো ঋণটি মন্দমানের খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সালে এপ্রিলে কালা মিয়া অটো পলিশের অনুকূলে দুই দফায় মোট ৪৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। এখন পর্যন্ত একটা টাকাও পরিশোধ করেনি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে। এদিকে বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার হারুন অর রশিদ খানসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মে জড়িত থাকার সরাসরি প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর লামিয়া শিপিং লাইন্সের অনুকূলে ৩০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। তার আগে শাখার প্রধান ঋণ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ খানের নেতৃত্বে প্রিন্সিপাল অফিসার ছাইদুর রহমান ও সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মির্জা তৈবুর রহমান প্রতিষ্ঠানটি সরেজমিন দেখে এসেছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে। কিন্তু যে তারিখে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন ওই তারিখে হারুন অর রশিদ খান ছিলেন ট্রেনিংয়ে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়েছে।
অথচ ২০১৫ সাল পর্যন্ত একটি টাকাও ফেরত দেয়নি সংশ্লিষ্ট গ্রাহক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শনে আরও দেখা যায়, হাজি তারা মিয়া পোলট্রি ফার্মের অনুকূলে ২০১২ সালের ৯ জুলাই প্রায় ৪ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখা। ২০১৫ সালে দেখা যায়, ঋণটি ৩০ মাস পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ। এরপরও প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ২০১৩ সালে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, যা প্রায় ২০ মাস ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ। উভয় ঋণে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম ঋণের অনুকূলে যে সম্পত্তির বন্ধকি দলিল দেখানো হয়েছে তা আরও একটি বেসরকারি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া শাখায় বন্ধকের মূল দলিল রক্ষিত নেই। দ্বিতীয় ঋণের ক্ষেত্রে হেবার মাধ্যমে দান করা সম্পত্তি জামানত হিসেবে নিয়েছে বিডিবিএল, যা পুরোটাই বেআইনি। নামের বানান কিছুটা পরিবর্তন করে একই ব্যক্তির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাজী তারা মিয়া অটো বয়লার অ্যান্ড রাইসের অনুকূলে ২০১২ সালের ১৯ জুন ১ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে বিডিবিএলের সংশ্লিষ্ট শাখা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঋণটিতে আদায় মাত্র ৬ লাখ টাকা। ঋণ হিসাবটি ৩০ মাস ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানে রয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের মালিক দেখানো হয়েছে কাওসার আহমেদকে। ১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ব্যাংকে জামানত দেখানো হয়েছে ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ জমি, যা অতিমূল্যায়িত এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সামান্য মূল্যের যে জমি ৩০ লাখ টাকা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সেই জমির মূল দলিলও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে দেখাতে পারেনি বিডিবিএল। জোহরা অটো ফুড প্রসেসিং মিলসের অনুকূলে ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ৪৮ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করে বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখা। প্রতিষ্ঠানটি একটি ভাড়া করা রাইস মিল। এর মালিক মো. অহিদুল্লাহ।
ঋণ গ্রহণের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গ্রাহক এক টাকাও পরিশোধ করেনি। ফলে বর্তমানে সুদে-আসলে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। পরিদর্শন তারিখে ঋণ হিসাবটি ১৯ মাস পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ। এরপরও একই গ্রাহকের অনুকূলে আরও ৪১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা মেয়াদি ঋণ অনুমোদন করা হয়, যার ২১টি কিস্তি অনাদায়ী। সর্বশেষ ঋণটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ লাখ ৪ হাজার টাকায়। উভয় ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন হচ্ছে, ভাড়ায় চালিত রাইস মিলের অনুকূলে মেয়াদি ঋণ অনুমোদন বেআইনি। এছাড়া জামানতকে অতিমূল্যায়িত করা হয়েছে। এমনকি ১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত রাখা হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ জমি। উপরোন্তু জমির মূল দলিল সংরক্ষণ করা হয়নি। একইভাবে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মেসার্স আর এ পোলট্রি ফিশ ফিড মিলসের অনুকূলে অর্ধকোটি টাকা, অনন্যা ব্রিকসের অনুকূলে অর্ধকোটি টাকা, রমজান অ্যান্ড ব্রাদার্সের অনুকূলে অর্ধকোটি টাকা, এসআইএস এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ৩৬ লাখ, সার্ক গার্মেন্টের অনুকূলে কয়েক দফায় ১ কোটি ও মডার্ন এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে অর্ধকোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসব ঋণের এক টাকাও ফেরত আসেনি। বর্তমানে কোনো ঋণ আদায় হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই। শাখাটির প্রায় ১১ কোটি টাকা এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে গেছেন ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়স্বজন। এর জন্য ব্যাংকের শীর্ষপর্যায় থেকে শাখাপর্যায়ে ঋণ বিতরণে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.