‘জান্নাতের লোভে’ জঙ্গি দলে যোগ দেয় জসিম-আরজিনা

খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছিল গ্রেফতার জঙ্গি জসিম (জহিরুল হক) এবং তার স্ত্রী আরজিনা (রাজিয়া বেগম)। তারা নব্য জেএমবির সদস্য হলেও ‘দাওলাতুল ইসলাম’ সংগঠনের নামে কাজ করত। রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, এ সংগঠনের হয়ে কাজ করার সময় মৃত্যু হলে জান্নাত অবধারিত- এমন বিশ্বাসেই এ পথে পা বাড়ায় তারা। ‘পরকালে জান্নাতের লোভে’ এ সংগঠনের ‘সুসাইড স্কোয়াড’ টিমের সদস্য বনে যায় এ দম্পতি। তবে সীতাকুন্ডের পশ্চিম আমিরাবাদ এলাকার ‘সাধন কুঠির’ থেকে গ্রেফতার এ জঙ্গি দম্পতি অনেক প্রশ্নেরই জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা থেকে পুলিশের প্রশিক্ষিত বিশেষ টিম চট্টগ্রাম আসার কথা। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানিয়েছে, এক ‘বড় ভাই’য়ের কাছ থেকে তারা অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও নিয়েছিল। বড় ভাই তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সংগঠনের হয়ে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়া চলবে না। এ জন্য তাদের সঙ্গে থাকত ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’। নির্দেশনা ছিল গ্রেফতারের উপক্রম হলেই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনে (তাদের ভাষায় তাগুত বাহিনী) আত্মঘাতী হামলার মধ্যে দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এ দম্পতির টিমে ৮ জন সদস্য ছিল। হৃদয় (রাফাদ আল হাসান) নামে এক যুবকের মাধ্যমে তারা দাওলাতুল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর হৃদয়ই তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করত। তাদের উপার্জনের আর কোনো পথ ছিল না। গত শুক্রবার এ জঙ্গি দম্পতিকে অস্ত্র ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১২ দিনের রিমান্ডে নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশের বিশেষ টিম। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলে, ‘বড় ভাই’ হামলার টার্গেটও ঠিক করে দেয়।
বিদেশী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিল্প-কারখানা এমনকি চট্টগ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও তাদের টার্গেটে ছিলেন। বুধবারের অভিযানে যে চারজন নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে আরজিনার ভাই কামাল ও তার স্ত্রী জোবাইদা ছাড়াও হৃদয় ও রাশেদেরও মৃত্যু হয়েছে। ছবি দেখেই চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশকে নিশ্চিত করে এ দম্পতি। প্রসঙ্গত ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হওয়া দুই খালাতো ভাই- রাফাদ আল হাসানের সাংগঠনিক নাম হৃদয় এবং আয়াদ আল হাসানের সাংগঠনিক নাম রাশেদ বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি দম্পতি পুলিশকে জানায়, ‘তাদের থাকা-খাওয়ার অর্থ জোগান দেয়া হতো সংগঠন থেকে। রাশেদ ও হৃদয় তাদের সঙ্গে সমন্বয় করত। তারাসহ এ টিমে ৮ জন সদস্য ছিল। এ টিমে সোহেল রানা এবং শাহনাজ নামে আরও দু’জন রয়েছে। তারা এখন কোথায় তা জানে না এ দম্পতি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ অনেক জঙ্গির ছবি দেখিয়েছে তাদের। এর মধ্যে রাশেদ এবং হৃদয়ের ছবি তারা চিনেছে। উদ্ধার করা এ ছবির পেছনে রাফাদ আল হাসান ও আয়াদ আল হাসান লেখা থাকায় নিহত দুই জঙ্গি হৃদয় ও রাশেদই যে রাফাদ আর আয়াদ তা নিয়ে তাদের আর কোনো সন্দেহ নেই। এরপরও তারা ডিএনএ টেস্ট করবেন এ দুই জঙ্গির। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নব্য জেএমবির চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মুসার ছবিও তাদের দেখানো হয়। তবে তারা চিনতে পারেনি। যে বড় ভাই তাদের অস্ত্র চালনা শিখিয়েছে বলে বলা হচ্ছে সেই বড় ভাইয়ের নাম তারা জানে না বলেও পুলিশকে জানিয়েছে। তবে মুসার নাম তারা শুনেছে বলে জানায়। রাশেদ ও হৃদয় বোমা তৈরির কারিগর ছিল এবং চট্টগ্রামের দুই জঙ্গি আস্তানায় যেসব বোমা বানানো হয়েছিল তা এ দু’জনই তৈরি করে। বুধবার সাধন কুঠিরে প্রথম দফায় পরিচয়পত্র নিয়ে যখন বাড়ির মালিকের সঙ্গে জঙ্গি দম্পতির কথাকাটাকাটি হয় তখন ওই বাসা থেকে কেটে পড়ে।
রাতে তারা দ্বিতীয় আস্তানা ছায়ানীড়ে অবস্থান নেয়। এদিকে নব্য জেএমবির চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মুসার যাতায়াত ছায়ানীড়ে ছিল বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। যদিও এ বিষয়টি স্বীকার করছে না জঙ্গি দম্পতি জসিম ও আরজিনা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) কুসুম দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, ‘জঙ্গিরা ছোট ছোট গ্রুপে ৭ থেকে ৮ জনে ভাগ হয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের টিমের সদস্যদের বাইরে যে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে এ রকম এক-দু’জন ছাড়া দলের বেশিরভাগই লোককে তারা চেনে না। যার কারণে এ সংগঠনকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। জঙ্গিদের অস্ত্র ও বিস্ফোরকের উৎসের সন্ধানে নেমেছে পুলিশ। সূত্র জানায়, ঢাকায় র‌্যাব ব্যারাকে বিস্ফোরিত গ্রেনেড সীতাকুণ্ড থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেডের মতোই। সীতাকুণ্ডের চৌধুরী বাড়ির ‘ছায়ানীড়’ ভবন থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেডের সঙ্গে ওই সব গ্রেনেডের মিল রয়েছে। একইভাবে সীতাকুণ্ডে উদ্ধার করা বোমার সঙ্গে মিল রয়েছে ৭ মার্চ কুমিল্লায় পুলিশ চেকপোস্টে হামলায় ব্যবহৃত বোমারও। কুমিল্লায় হামলার সময় গ্রেফতার করা হয় হাসান ও ইমতিয়াজ ইমু নামে দুই জঙ্গি সদস্যকে। গ্রেফতারের পর তারা পুলিশকে বলেছে, ধরা পড়ার এক সপ্তাহ আগে আরও যে ৮টি বোমা ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল সেই বোমাই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে ঢাকায় র‌্যাব ব্যারাকে। এসব বোমা তৈরি হতো চট্টগ্রামের পটিয়ায় এবং পরে সীতাকুণ্ডের ‘ছায়ানীড়’ নামের ওই বাড়িতে। বোমা তৈরির এসব কাঁচামাল চট্টগ্রাম নগরী,
সীতাকুণ্ডসহ দেশের বিভিন্ন খুচরা দোকান থেকে সংগ্রহ করা হতো। ইতিমধ্যে ওইসব এলাকার কয়েকটি দোকানের নামও পেয়েছে পুলিশ। আটক জঙ্গি দম্পতি ও বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার জঙ্গি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নব্য জেএমবি মসজিদ-মাদ্রাসার নাম করে যেমন চাঁদা তোলে তেমনি সোনার দোকান, হুন্ডির টাকা ছিনতাই করেও তারা ফান্ড গঠন করে। চট্টগ্রামের সদরঘাটে ২০১৫ সালে এক ব্যবসায়ীর ওপর বোমা হামলা করে বিপুল পরিমাণ টাকা লুট করেছিল নব্য জেএমবি। ওই ঘটনায় এক জঙ্গি সদস্য ও এক ব্যবসায়ীও নিহত হয়। সে সময় গ্রেফতার জেএমবির একাধিক সদস্য পুলিশকে জানায়, তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফান্ড গঠন করতেই এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। তিনি এও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নব্য জেএমবি অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করছে। আন্তর্জাতিকভাবে চেনার জন্য জেএমবির শাখা সংগঠন হিসেবে ‘দাওলাতুল ইসলাম’র নামেই নব্য জেএমবি কার্যক্রম চালাত। তাছাড়া তারা কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। এক ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে টিমের সদস্যদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করত। এদিকে জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি দম্পতির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রামের বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের যৌথ খামার বাড়ি এলাকায় অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। এ প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লায় পুলিশের চেকপোস্টে হামলার সময় বোমাসহ হাতেনাতে আটক হাসানের বাড়ি বান্দরবানের বাইশারীতে।
এখনও মর্গে জঙ্গির লাশ : সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে এক শিশু ও চার জঙ্গির লাশ এখনও পড়ে আছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের পুরো শরীর এত বেশি বিকৃত হয়েছে যে তাদের চেনার উপায় নেই। এ কারণে তাদের লাশ যারা দাবি করবে তাদের ডিএনএ টেস্ট করানোর পর লাশ দেয়া হবে। এছাড়া এর আগেও যদি লাশ কোনো স্বজন চিনতে পারেন তাহলে সে ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে। জঙ্গিদের টার্গেট : জঙ্গিদের টার্গেট সাধারণ মানুষ নয়, টার্গেট পুলিশসহ অন্যরা। এজন্য তারা সাধারণ মানুষকে মারার পক্ষপাতী নয়। সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সীতাকুণ্ডের ‘ছায়ানীড়’ ভবনে প্রথমে একটি পরিবার আমাদের ফোন করে কান্নাকাটি করে। তারা ফোন করে বলেছে তাদের দরজার কড়া নাড়া হচ্ছে। আমরা তখন বলেছি, কাউকে যাতে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেয়া না হয়। দরজার সামনে ঘরের আলমিরাসহ ভারি কোনো বস্তু রাখার পরামর্শ দেই। একে একে ওই বাসার তিনটি পরিবারও এ কাজ করেছে। এরপরও সাধারণ মানুষকে মারার ইচ্ছা থাকলে তাদের কাছ থেকে যে প্রকার শক্তিশালী বোমা পাওয়া গিয়েছিল তা দরজার সামনে রাখলে দরজাসহ উড়ে যেত।
এতে বোঝা যায় তাদের টার্গেট সাধারণ মানুষ নয়। যেখানে ভাড়াটিয়া সেখানে অভিযান : যেখানে ভাড়াটিয়া আছে সেখানে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। এ সিদ্ধান্ত শনিবার চট্টগ্রাম রেঞ্জের মাসিক অপরাধবিষয়ক সভায় জেলা পুলিশ সুপারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি থানায় টিম গঠন করে যে এলাকায় বাসা ভাড়া থাকে ওই এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ওই সব ভাড়া বাসায় অভিযান চালানো হবে। অভিযানে কোনো কিছু পাওয়া না গেলেও ভাড়াটিয়ার ভোটার আইডি কার্ড নেয়া হবে। কি কারণে তারা ভাড়া থাকেন তা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আরও ১৮ বোমা নিষ্ক্রিয় : সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, সীতাকুণ্ডের জঙ্গি আস্তানা ছায়ানীড় থেকে উদ্ধার করা আরও ১৮টি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিএমপির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এসব বোমা নিষ্ক্রিয় করে।

No comments

Powered by Blogger.