বই ও প্রকাশনার ইতিকথা

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির পর পূর্ব বাংলার মানুষের জাতীয়তাবোধে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। যে যে ধর্মের অনুসারীই হোক, তারা বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় বাঙালি মুসলমান মুসলিম জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বাহান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তারা—একটি ছোট সাম্প্রদায়িক অংশ বাদে—বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়। এবং তার প্রকাশ ঘটে মাত্র দুই বছর পর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনের সময়। মুসলিম জাতীয়তাবাদী ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে তারা বর্জন করে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল বিখ্যাত ২১ দফা। যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক চক্র বিচিত্র রকম ষড়যন্ত্র করে। তা সত্ত্বেও ওই সরকার নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বেশ কিছু প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম যৌথভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদপ্রসূত। যুক্তফ্রন্টের প্রধানতম দল ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৬-এর সেপ্টেম্বর থেকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির দিন পর্যন্ত। আতাউর রহমানের সরকারের সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার আরও বিকাশ ঘটে। বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নতির লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেওয়া হয়। তাঁর সরকারের সময়ই ১৯৫৭-এর ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী আয়োজিত ঐতিহাসিক কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইলে। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান সরকারের সময়ের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তিন দিনব্যাপী পুস্তক প্রদর্শনী: বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। সেটি ছিল ঢাকার বইয়ের প্রকাশক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ আয়োজন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন সুলতানউদ্দিন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯২০ দশক থেকেই গভর্নর সুলতানউদ্দিন ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান বন্ধু ছিলেন। সলিমুল্লাহ হলের পুস্তক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন গভর্নর সুলতানউদ্দিন। সেটি ছিল পাকিস্তানের রাজনীতির খুবই খারাপ সময়। তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে গভর্নর বলেছিলেন: ‘বর্তমান দুঃখজনক পরিবেশে আমাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সমগ্র দুনিয়ায় যে সব সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে, তাদের কোনো না কোনো সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
বাধাবিঘ্নের ফলে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ নতুনভাবে উৎসাহ লাভ করে থাকে। কোনোরূপ সংকট না থাকলে কোনো সভ্যতার অভ্যুদয় হতো না।’ সেকালের রাজনীতিবিদেরা শুধু উচ্চশিক্ষিতই ছিলেন না, তাঁরা অনেকেই যথেষ্ট পড়াশোনা করতেন। বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কেও সুলতানউদ্দিনের পড়াশোনা ছিল। সেদিন তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, পূর্ব বাংলার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা একদিন একটি নতুন সভ্যতার জন্ম দেবেন। পুস্তক প্রদর্শনীর সমাপনী দিবসে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই বইমেলার তিন সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানে আবির্ভাব ঘটে সামরিক স্বৈরশাসনের। ঢাকার প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাস দীর্ঘ—দেড় শ বছরের। এখানকার প্রকাশনার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চল্লিশের শেষ দিক থেকে। পঞ্চাশের দশকে তা একটি আকার ধারণ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে এদিকের বাঙালি মুসলমানদের যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কলকাতায় ছিল, তাঁরা অনেকে সেখানকার ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। যাঁরা তখন ঢাকায় এসে প্রকাশনাশিল্পের গোড়াপত্তন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করতে হয় দুই বন্ধুর নাম। তাঁরা হলেন আয়নুল হক খান ও মোহাম্মদ নাসির আলী। তাঁরা শুরু করেন তাঁদের নওরোজ কিতাবিস্তান,
বাংলাবাজারে। বাংলাবাজারে তখন আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশক ছিলেন, তিনি আমাদের মানিকগঞ্জ শহরের অধিবাসী এবং আমার বাবার শৈশবের বন্ধু অনিলচন্দ্র ঘোষ। তাঁর ছিল প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি। প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা, তবে কলকাতার কলেজ স্কয়ারেও একটি শাখা ছিল। অনিল ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী। জেল-জুলুম খেটেছেন বহুবার। নিজেও লেখক ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রকাশিত প্রথম বইটিই তাঁর। সলিমুল্লাহ হলের সেই প্রথম বইমেলায় যেসব প্রকাশনা সংস্থা অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, নওরোজ কিতাবিস্তান, ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, ইস্ট বেঙ্গল বুক সিন্ডিকেট, কোহিনূর লাইব্রেরি, পাকিস্তান বুক করপোরেশন, প্যারাডাইজ লাইব্রেরি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি, মোহাম্মদী বুক হাউস, লিয়াকত পাবলিশিং হাউস, আইডিয়েল পাবলিকেশনস, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, সরোজ লাইব্রেরি, সোবহানিয়া লাইব্রেরি প্রভৃতি। ওই সব প্রকাশনীর নাম উল্লেখ করলাম এ জন্য যে তারা আমাদের পথনির্মাতা। তাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আজ আমরা বিশাল বইমেলা করছি, শত শত প্রকাশক অংশগ্রহণ করছেন। এই সময় সেদিনের সেই অল্পসংখ্যক প্রকাশকের ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। সেদিন ঢাকা শহর ছিল পরিসরে ছোট। সাংস্কৃতিক ঘটনা ঘটত কম। যখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো অনুষ্ঠান হতো, তখন তা নগরবাসীর চোখে পড়ত। পুস্তক-প্রদর্শনী বলা হলেও, তাতে বই বিক্রির ব্যবস্থাও করেছিলেন অংশগ্রহণকারী প্রকাশকেরা। পঞ্চাশের দশকে দেখেছি, অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতার বইয়ের আকার হতো ক্রাউন। ডিমাই আকারে বই প্রকাশের প্রথা ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে চালু হয়। সেকালের প্রকাশকেরা লেখকদের সঙ্গে, সততার সঙ্গে ব্যবসা করতেন।
বইয়ের নামপত্রে উল্লেখ থাকত: প্রথম সংস্করণ ১২৫০ কপি, দ্বিতীয় মুদ্রণ ১১৫০ কপি, তৃতীয় সংস্করণ ১২০০ কপি প্রভৃতি। এখন প্রকাশনাশিল্প ঢাকাসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম ছাড়া কোনো বড় জেলা শহরে সাহিত্যের বইয়ের বড় প্রকাশনা বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকেও দেখা যায় অনেক জেলা শহর থেকে পাঠ্যবই তো বটেই, সাহিত্যের বইও প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই ছিলেন ঢাকার প্রকাশকদের বইয়ের নামকরা পরিবেশক। চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, দিনাজপুর, কুমিল্লা প্রভৃতি শহরে বইয়ের প্রকাশক, পরিবেশক ও বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বেশ কিছুসংখ্যক। অনুমান করি, ঢাকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারা প্রকাশনার ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। একুশের বইমেলায় জেলা শহরের খ্যাতিমান প্রকাশক কজন আছেন? ষাটের দশক পর্যন্ত কুমিল্লা ছিল ছোট্ট, স্নিগ্ধ ছায়াচ্ছন্ন মনোরম মহকুমা শহর। কিন্তু সেখানকার সংস্কৃতিচর্চার মান ছিল উঁচু। কুমিল্লাকে বলা হতো ব্যাংক এবং ট্যাংকের (পুকুরের) শহর। কিন্তু সেখানেও কয়েকজন প্রকাশক ছিলেন। তার মধ্যে পপুলার বুক এজেন্সির কথা বলা যায়। তার স্বত্বাধিকারী ছিলেন তড়িৎ মজুমদার—মোতাহের হোসেন চৌধুরীদের বন্ধু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি কলকাতা গিয়ে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। তিরিশের দশকেই কুমিল্লায় প্রকাশনা শুরু করেছিলেন পূর্বাশা পত্রিকার সম্পাদক ও কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য এবং তাঁর ভাই অজয় ভট্টাচার্য্য। তাঁদের প্রকাশনার নাম ছিল পূর্ব্বশা প্রকাশনী লিমিটেড। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নয়নচারা গল্পগ্রন্থটির প্রকাশক সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। নয়নচারা প্রকাশিত হয় চল্লিশের মাঝামাঝি। বইয়ের প্রসঙ্গে সাধারণ পাঠাগারের কথাও আসে। একসময় পূর্ব বাংলায় বহু সাধারণ পাঠাগার ছিল। ১৯৫০ নাগাদ সেগুলোর অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমলে পৌরসভা ও জেলা বোর্ড থেকে সাধারণ পাঠাগারগুলোকে কিছু অর্থসাহায্য দেওয়া হতো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অর্থের অভাবে সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ই আবার তা চালু হয়। ১৯৫৪-৫৫ অর্থবছরে প্রথম পাবলিক লাইব্রেরির জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯৫৫-তে শেরেবাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের উদ্যোগে ঢাকায় ‘কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি’র ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৫৫-তে ১৫টি জেলার সাধারণ পাঠাগারকে দুই হাজার টাকা করে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই বছরই বেসরকারি পাঠাগারগুলোর জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক শিক্ষাসচিব বলেছিলেন: ‘এই লাইব্রেরি শুধু ঢাকার নাগরিকদের অধ্যয়নের সুযোগ দান করিবে না; বরং ইহা হইবে এই দেশের সকল লাইব্রেরির প্রাণকেন্দ্র।’ প্রকাশনাশিল্পের উন্নতির জন্য সাধারণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও তার উন্নতি ঘটানো অতিপ্রয়োজন। কোনো জাতির সামগ্রিক উন্নতির প্রতিফলন ঘটে সেই জাতির বইপত্রে—দালানকোঠা, ব্রিজ-কালভার্ট প্রভৃতি অবকাঠামোর সংখ্যা দিয়ে নয়। সৃষ্টিশীল-মননশীল ও গবেষণামূলক দুই ধরনের বই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর আমাদের প্রকাশনাশিল্প বিকশিত হয়েছে, যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন তার মানের বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে, পরিমাণ ও সংখ্যা দিয়ে সবকিছুর উৎকর্ষ বিচার্য নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.