মাইক্রোবাস কেটে অ্যাম্বুলেন্স

অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের বিরুদ্ধে বিআরটিএর অভিযানে কাজ হচ্ছে না। ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা বেআইনি হলেও তা চলছে। লক্কড়ঝক্কড় অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে এবং অন্য যানকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করে এই ব্যবসা করছেন কতিপয় ব্যক্তি, যা রোগীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীর চারটি প্রধান সরকারি হাসপাতালের সামনে গিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার চিত্র দেখা গেছে। গত সপ্তাহে পরপর দুই দিন এসব হাসপাতালের সামনে যে ৫৮টি অ্যাম্বুলেন্স দেখা গেছে, এর ৫৫টিতেই রোগী বহনে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম দেখা যায়নি। এগুলো নিয়ম না মেনে ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এ ছাড়া সিএনজিতে চলা অনুচিত হলেও বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সই সিএনজিচালিত। গত বছরের ১৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ফটকে ব্যক্তিমালিকানার একটি অ্যাম্বুলেন্সের চাপায় রোগীসহ পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটলে অবৈধ এই ব্যবসার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ওই অ্যাম্বুলেন্সের মালিক মাহফুজুর রহমান হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডবয়। পুলিশ এখনো তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এই দুর্ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে সব অ্যাম্বুলেন্স সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনের সড়কে, জরুরি বিভাগ এবং বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের মাঝের স্থানে ব্যক্তিমালিকানার ২০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর একটির (নম্বর ঢাকা মেট্রো চ ১১-৩৯৩৪) চালক বাপ্পী হোসেন বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটির মালিক হাসপাতালের প্রয়াত এক কর্মচারী। মাইক্রোবাস কিনে এটিকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করলেও বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেওয়া হয়নি। পাশের অ্যাম্বুলেন্সটির (ঢাকা মেট্রো ছ ৭১-১৫৯৩) নিবন্ধন থাকলেও সেটি পুরোনো ও চলছে ব্যক্তিমালিকানায়। অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধন দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন হয় ‘ছ’ সিরিয়ালে। বিআরটিএর মিরপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিবন্ধন বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, কেবল সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্সকেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। ব্যক্তিমালিকানার অ্যাম্বুলেন্স চলাচল অবৈধ। বিআরটিএ বলছে, অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধন পেতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন: রোগীর জন্য স্থায়ী শয্যা (মাথার দিকে রিভলবিং), অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক, চিকিৎসক বসার ব্যবস্থা, স্ট্রেচার ও সাইরেন থাকতে হবে। এ ছাড়া চালক, চিকিৎসক, রোগীসহ সর্বোচ্চ ছয়জন বহন করা যাবে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৪ হাজার ৫২৭টি অ্যাম্বুলেন্সের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সিংহভাগ অ্যাম্বুলেন্সই সব শর্ত পূরণ করেনি।
আর অ্যাম্বুলেন্সের অধিকাংশই ব্যক্তিমালিকানার। আবার এগুলোর বেশির ভাগেরই অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধন নেই। নিবন্ধন রয়েছে মাইক্রোবাস, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইভেট কার হিসেবে। অর্থাৎ বিভিন্ন যানকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হলেও নতুন নিবন্ধন নেওয়া হয়নি। অভিযোগ আছে, সঠিক নজরদারির অভাব ও বিআরটিএর কিছু অসাধু কর্মীর সহায়তায় অ্যাম্বুলেন্স নাম নিয়ে এসব যান চলছে নির্বিঘ্নে। বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, গত অক্টোবরে প্রথম আলোতে বেআইনি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা নিয়ে খবর ছাপার পর রাজধানীতে অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের বিরুদ্ধে বিআরটিএর চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান শুরু করেন। অভিযান এখন আরও জোরদার করা হয়েছে। ওই কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা; পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইভেট কারকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করলেও নিবন্ধন না নেওয়ায় গত চার মাসে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত ছয়টি অ্যাম্বুলেন্সকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পুলিশের (ডাম্পিং) কাছে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া রোগী বহনের বিভিন্ন শর্ত পূরণ না করায় এবং অ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী বহনের অভিযোগে ৪০টি অ্যাম্বুলেন্সকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সরেজমিন চিত্র ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালসংলগ্ন নার্সিং ইনস্টিটিউটের পাশের সড়কে থাকা আটটি অ্যাম্বুলেন্সই ব্যক্তিমালিকানার। এর একটির নম্বরপ্লেটে লেখা ঢাকা মেট্রো ঠ ১১-২২৭৮। গাড়িটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় কোনো সরঞ্জামই নেই। বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ঠ’ সিরিয়াল হয় পিকআপের। অর্থাৎ পিকআপকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হয়েছে। অপর একটির নম্বরপ্লেটে লেখা ঢাকা মেট্রো গ ১৪-০৯৮৬।
পাশেরটির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ ১৪-৯২৮৭। বিআরটিএ বলেছে, ‘গ’ সিরিয়াল প্রাইভেট কারের। পরদিন শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) জরুরি বিভাগের আশপাশে ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স লেখা যান দেখা গেল। এর ১৩টিই ব্যক্তিমালিকানার। একটির নিবন্ধন ‘ঠ’ সিরিয়ালের। অর্থাৎ পিকআপকে অ্যাম্বুলেন্স বানানো হয়েছে। আরেকটির নম্বরপ্লেটে লেখা ঢাকা মেট্রো শ ১১-০০৪৫। বিআরটিএর যান পরিদর্শক এম এ জলিল বলেন, ‘শ’ সিরিয়াল রেফ্রিজারেটর ভ্যানের। অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক ও চিকিৎসক বসার আসন না থাকা যানটির চালক মো. বাবুলের দাবি, এটি লাশবাহী গাড়ি। তবে প্রয়োজনে রোগীও বহন করা হয়। আধা ঘণ্টা পর কাছেই জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আশপাশে ফাঁকা জায়গায় থাকা ১৬টি অ্যাম্বুলেন্সের ১৫টিই ব্যক্তিমালিকানার। বেশির ভাগেই রোগীর স্থায়ী শয্যা ও চিকিৎসক বসার আসন নেই। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মমিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের ৬০০ অ্যাম্বুলেন্সের মালিক এই সমিতির সদস্য। আগে বিআরটিএ ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দিত, এখন দেয় না। তাঁর মতে, সব অ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসক বসার ব্যবস্থা রাখা সম্ভব নয়। মুমূর্ষু রোগীবাহী এসি অ্যাম্বুলেন্সে এ ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছ’ সিরিয়ালভুক্ত নয় এবং শর্ত পূরণ করা ছাড়া কোনো অ্যাম্বুলেন্স চলতে পারবে না। এসব যানে রোগী বহনও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব যান বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সনদ পায় কীভাবে? ট্রাফিক পুলিশও এসব আটক করে না। তিনি বলেন, সরকারকে নিরাপদে রোগী বহন নিশ্চিত করতে হবে। সরকার রোগী বহনের জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.