ভিসুভিয়াস একটা আগ্নেয়গিরির নাম

উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বেকারত্ব বিষয়ে প্রথম আলোয় ২১ ফেব্রুয়ারি ‘পাওয়ার সময় হারানোর পালা’ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘বেকারত্বের দিনগুলিতে বিচ্ছেদ’ শিরোনামে দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর এই লেখকের ইলেকট্রনিক চিঠির বাক্সে ৬০টি চিঠি জমে উঠেছে। জানুয়ারির ১২ তারিখে ‘উচ্চশিক্ষিত বেকারদের অপরাধ কী?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পরও অনেক পাঠক লেখককে চিঠি লিখেছিলেন। দেশ ও জাতির অনেক সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রথম আলোতেই এই লেখকের অনেক নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোনো লেখার প্রতিক্রিয়ায় এত বিপুলসংখ্যক পাঠকের চিঠি পাওয়ার অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম। এ থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়, এ দেশের উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজের বেকারত্ব কত ব্যাপক ও গভীর একটা জাতীয় সমস্যা। কিন্তু পত্রলেখকদের অধিকাংশের অভিযোগ, যাঁরা দেশ পরিচালনা করেন, নীতিনির্ধারণ করেন, যাঁরা শিল্প-ব্যবসা-সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেন, তাঁরা এই সমস্যার প্রতি একেবারেই উদাসীন। ‘আমাদের কথা কেউ ভাবে না’—এই হলো উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবসমাজের সাধারণ অভিযোগ।
এক পাঠিকা লিখেছেন, ‘...প্রথম আলোতে “উচ্চশিক্ষা ও বেকারত্ব” বিষয়ে আপনার দুটি লেখাই পড়েছি আমি। প্রথম লেখাটি পড়ে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আপনাকে সাক্ষাতে ধন্যবাদ জানাই। দ্বিতীয় লেখাটি পড়ার পর মনে হলো একজন বেকার হিসেবে জীবনের যে বাস্তবতাগুলো আমাকে অনবরত কাঁদিয়ে যাচ্ছে, আজকের লেখাটিতে আমার সে কান্না আর হতাশাগুলোকে অজস্র শব্দরাশি দিয়ে সাবলীল ভাষায় আপনি প্রকাশ করলেন।’ আরেক পাঠকের দীর্ঘ চিঠির অংশবিশেষ এ রকম: ‘স্যার, আমি বেকারালয় থেকে একজন বেকার বলছি। আমরা এই বেকারালয়ে ছয়জন বেকার মানবেতর জীবন যাপন করছি। প্রথম আলোতে আপনার লেখা পড়ে আমার অনুভূতি হলো দুচোখের জল গড়িয়ে পড়া। তবে ভালো লাগছে এই ভেবে যে, অনেক লেখকের ভিড়ে আপনিই একমাত্র আমাদের কথা লিখেছেন। আমার আপন বড় ভাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং এমবিএ পাস করে চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পর আজ এমপিওবিহীন একটি কলেজে বেতনবিহীন চাকরি করছে। আর আমিও সেই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং এমবিএ পাস করে এসে বেকারত্বের দুই বছর পূরণ করেছি। পাঁচটি ব্যাংকে ভাইভা দিয়েও এখনো চাকরি হয়নি। সামনে ৩৬তম বিসিএসের ভাইভা দিব। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। দেখি, এই কষ্ট আর কত দিন সইতে হয়।... কোম্পানি আগামীকাল লিখিত পরীক্ষার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাদের এমবিএ ডিগ্রিধারী লোক লাগবে, অথচ বেতন মাত্র ১৫ হাজার টাকা...।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘কোনো এক সরকারি চাকরির ভাইভার প্রস্তুতি নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আপনার কলামখানি চোখে পড়ল। ১০ হাজার প্রার্থী থেকে দ্বিতীয় ভাইভায় ১০০ জন লড়াই করব এবং সর্বশেষ আরেকটা ভাইভা হবে। কিন্তু বুক ভেঙে যায় যখন শুনি চূড়ান্ত নয়জনের পাঁচজনকেই চাকরি দেওয়া হবে নির্ধারিত কোটা থেকে। মা-বাবার মলিন মুখখানি স্মরণ করতে করতে হয়তো বালিশচাপা দিয়ে ঘুমিয়ে যাব।
তবে এত কষ্ট করে বিবেকহীন এই সব সিদ্ধান্তে জীবন ব্যর্থ হলে জবাব আদায় করে নিব।...আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ আপনার লেখনী দিয়ে সবচেয়ে অভাগাদের পাশে থাকবার জন্য।’ অর্থনীতিবিদেরা বলেন, আর্থিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেই কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয় না। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়ার নয়। একটা সমাজে বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত ও কর্মক্ষম মানুষ চাকরির জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে, কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না—এমন অবস্থা নানা রকম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই শুধু অর্থনীতিবিদেরা নন, সমাজবিজ্ঞানী, উন্নয়ন-গবেষক, দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর নীতিনির্ধারকসহ অনেকেই কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। কী উপায়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, সে বিষয়ে নানা ধরনের সুপারিশ–পরামর্শও অনেকে দিয়ে থাকেন। বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান গিভেন্সি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল ‘উচ্চশিক্ষিত বেকারদের অপরাধ কী?’ শিরোনামের নিবন্ধটি পড়ার পর লেখকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন এবং সাক্ষাতে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সপ্তাহ দুই আগে রাজধানীর উত্তরায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে লেখকের দীর্ঘ সময় আলাপ হয়। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান মূলত বস্ত্র ও তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি করে, মোট কর্মীর সংখ্যা ২৬ হাজার। মার্চেন্ডাইজিং ও আমদানি-রপ্তানির কাজে দক্ষ কর্মীর অভাব অত্যন্ত প্রকট—এ কথা বলে তিনি মন্তব্য করেন, আমাদের উচ্চশিক্ষিত জনবলের মান হতাশাব্যঞ্জক। বিশেষায়িত কাজের ক্ষেত্রে দক্ষ লোকবলের অভাব পূরণ করতে তাঁরা বিদেশ থেকে লোক আনতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, এটা শুধু তাঁর প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা নয়, পুরো তৈরি পোশাক খাতেরই বাস্তবতা। তৈরি পোশাক ও চামড়াশিল্প প্রতিষ্ঠান আরএমএম গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অনিরুদ্ধ রায়ও লেখককে একই সমস্যার কথা বললেন। অনার্স-মাস্টার্স মিলিয়ে প্রায় ছয় লাখ তরুণ-তরুণী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা শেষ করছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা চাকরি খুঁজছেন, তাঁদের মধ্যে যোগ্য-মেধাবী কি একেবারেই নেই? লেখকের এই প্রশ্নের উত্তরে শিল্পপতি অনিরুদ্ধ রায় বললেন, ‘যারা মেধাবী, দুঃখের বিষয়,
তাদের নৈতিকতায় সমস্যা দেখি।’ তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করে বললেন, যেসব কর্মীকে তিনি বিদেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এনেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। গিভেন্সি গ্রুপের চেয়ারম্যান খতিব আবদুল জাহিদ এ বিষয়ে আরও তিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, তিনি যেসব কর্মীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যাঁদের প্রতি বেশি স্নেহ দেখিয়েছেন, যাঁদের ওপর বেশি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই নানা রকম অনৈতিক কাজ করে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করেছেন। তাই এখন কোনো সংস্থা থেকে কর্মী প্রশিক্ষণের চিঠি এলে তিনি সেই চিঠি ছিঁড়ে ফেলেন, কোনো কর্মীকেই আর প্রশিক্ষণে পাঠান না। অনিরুদ্ধ রায় ও খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল—উভয়েই বললেন, বিদেশি কর্মীরা অন্তত ‘চুরি’ করার চেষ্টা করেন না, বেশি বেতনের লোভে চুক্তি ভঙ্গ করে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যান না। শিল্প খাতে মধ্যম স্তরে দক্ষ লোকবলের অভাব শুধু তৈরি পোশাকশিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তথ্যপ্রযুক্তি, বিভিন্ন সেবা খাত এমনকি চিকিৎসা খাতেও বিদেশি কর্মী আছেন। কিন্তু তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা কত, সে হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। কেউ বলেন ৫০-৬০ হাজার, কেউ বলেন ১ লাখ। বছরে তাঁদের মোট গড় আয় চার শ থেকে সাত শ কোটি ডলার; অর্থাৎ এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা তাঁদের মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যায়। অনেক বিদেশি নাগরিক পর্যটকের ভিসায় এসে চাকরি করেন, ভিসার মেয়াদ শেষে স্বদেশে বেড়াতে গিয়ে নতুন ভিসা নিয়ে আবার আসেন। তাঁরা চাকরি করেন বাংলাদেশি কর্মীদের তুলনায় অনেক উচ্চ বেতনে। তাঁদের মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি পাকিস্তানের নাগরিকেরাও আছেন বলে শোনা যায়। আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের যোগ্যতা-দক্ষতার অভাব প্রকট—এই অভিযোগ নিজেরা তাঁরা মানতে চান না। অনেক পাঠক চিঠিতে অভিযোগ করেছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বেরিয়ে চাকরির আবেদন করতে গেলে তাঁদের বলা হয়, অভিজ্ঞতা ছাড়া চাকরি হবে না। এই তরুণদের প্রশ্ন: চাকরি শুরু করার সুযোগই যদি না দেওয়া হয়, তাহলে কী করে তাঁদের অভিজ্ঞতা হবে? অনেক তরুণের অভিযোগ, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি কাজ করে। চাকরির ইন্টারভিউগুলো নিষ্ঠুর প্রহসন, কাদের নেওয়া হবে তা আগেই ঠিক করা থাকে—এমন অভিযোগও কোনো কোনো তরুণের মুখে উচ্চারিত হলো ক্ষোভের সঙ্গে। চিঠিলেখকদের মধ্যে যাঁরা সরকারি চাকরির চেষ্টা করছেন, তাঁরা কোটা-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকের অনুরোধ, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করার বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩২ বছর করা হোক। উচ্চশিক্ষিত বেকার পাঠক-পাঠিকাদের চিঠিগুলোর সবই আবেগময়: দুঃখ, ক্ষোভ, অভিমান, অসহায়ত্ববোধ, আত্মগ্লানি—এসব আবেগে ভরা। প্রচণ্ড ক্রোধও টের পাওয়া যায় কারও কারও লেখায়। কিন্তু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের আবেগ যত তীব্র আর যৌক্তিক হোক না কেন, রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠানের কাছে তা গুরুত্ব পায় না। বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির একই ধরনের আবেগ ব্যাপক মাত্রায় পুঞ্জীভূত হয়ে প্রচণ্ড সামাজিক-রাজনৈতিক বিস্ফোরণ অত্যাসন্ন করে না তোলা পর্যন্ত রাষ্ট্র-সরকার-প্রতিষ্ঠানাদির বোধোদয় সাধারণত ঘটে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে লেখকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে বাংলাদেশের বেকারদের মনের অবস্থা বর্ণনা করলেন ‘ঘুমন্ত ভিসুভিয়াস’ বলে।
ভিসুভিয়াস একটা আগ্নেয়গিরির নাম।
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.