বিরোধী দমনে ট্রাম্পও ‘গণশত্রু’ তকমা বেছে নিচ্ছেন?

‘গণশত্রু’—এই আক্রমণাত্মক অভিধাটি নিকিতা ক্রুশ্চেভেরও অপছন্দ ছিল। অথচ এই বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট খুব বেশি খুঁতখুঁতে হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা হিসেবে তিনি গণশত্রু কথাটির ব্যবহার বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, এটা যেকোনো ‘আদর্শিক লড়াইয়ের সম্ভাবনাকে নির্মূল করে’। ক্রুশ্চেভ ১৯৫৬ সালে এক বক্তৃতায় বলেন, সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিদের নিশ্চিহ্ন করতেই গণশত্রু অভিধাটির ব্যবহার চালু করা হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গণশত্রু কথাটির ঐতিহাসিক অনুরণন সম্পর্কে অবগত কি না, সেটা জানা কঠিন। সাধারণত স্বৈরাচারী কমিউনিস্ট সরকারপ্রধানেরাই এমন ভাষা ব্যবহার করতেন।
কিন্তু একটা গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত নেতার কেন গণশত্রু কথাটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে? স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নেও তো সে রকম বিদ্বেষপূর্ণ নেতৃত্ব আসেনি, যিনি কাউকে গণশত্রু তকমা দিতেন। ট্রাম্প নিজ দেশের জনগণের একটি অংশকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছেন। নিউইয়র্ক টাইমসসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকে তিনি ‘ভুয়া খবর’ প্রচারক আখ্যা দিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ইঙ্গিত করেই তিনি গণশত্রু কথাটি ব্যবহার করেছেন। গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমি ভুয়া খবরকে গণশত্রু বলেছি। কারণ, এগুলোর কোনো সূত্র বা উৎস নেই—পুরোটাই বানোয়াট।’ গণশত্রু বলতে ট্রাম্প কেবল ‘অসৎ’ সাংবাদিক ও সম্পাদকদের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তাঁর ওই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ঢুকতে দেননি। ক্রুশ্চেভের নাতির মেয়ে নিনা ক্রুশ্চেভা এখন নিউইয়র্কের নিউ স্কুলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। তিনি বলেন, স্তালিন-পরবর্তী যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নে গণশত্রু কথাটি কদাচিৎ শোনা গেছে। এটা স্বৈরতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের ভাষা। যেকোনো দেশেই এটা ব্যবহার করে সমালোচকদের ওপর আক্রমণ করা হতে পারে। ট্রাম্প সম্ভবত লেনিন, যোসেফ স্তালিন বা মাও সে তুং পড়েননি। তবে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে অবমাননা, আক্রমণ, তকমা আরোপ প্রভৃতির ভাষা সব সময় একই ধরনের হয়ে থাকে। গণশত্রু অভিধাটি রাজনৈতিক অভিধানে প্রথম প্রবেশ করে ১৭৮৯ সালে, ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
বিপ্লবীরা যেকোনো বিরোধিতাকারীর বিরুদ্ধে স্লোগান হিসেবে কথাটা ব্যবহার করতে শুরু করে। নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেন ১৮৮২ সালে এন এনিমি অব দ্য পিপল নামে একটি নাটক লেখেন। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অভিধাটি আবার ফিরে আসে। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন ক্ষমতা নিয়ে নিজ শত্রুদের গণশত্রু আখ্যা দিতে শুরু করেন। পুঁজিবাদীদের পাশাপাশি লেনিনপন্থীদেরও তিনি একই তকমা দিতেন। পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির রুশ ও পূর্ব ইউরোপীয় অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মিশের এ অরেনস্টেইন বলেন, গণশত্রু তকমাটির মানে আসলে মৃত্যুই ছিল। কাউকে এ কথা বলার মানে তিনি মানুষের চেয়ে নিচু স্তরের এবং সম্পূর্ণ বিনাশের যোগ্য। চীনের সাবেক বিপ্লবী প্রয়াত মাও সে তুংও গণশত্রু কথাটি ব্যবহার করেছিলেন, তবে নিজ দেশের কাউকে উদ্দেশ করে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে। তিনি ১৯৬৪ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পুরো বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক গণশত্রু হিসেবে ঘোষণা দেন।

No comments

Powered by Blogger.