আমি বনফুল গো by ইকবাল মতিন

কানন দেবীর সঙ্গে লেখক
কিংবদন্তি নায়িকা ও গায়িকা, বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের গ্ল্যামার কুইন কানন দেবীর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে কাল ২২ এপ্রিল। ১৯১৬ সালের এই দিনে তাঁর জন্ম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসার। তাঁর কাছ থেকে সন্তানতুল্য ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম। মৃত্যুর ২ বছর আগে ১৯৯০ সালের ১৬ মে কলকাতার ১ নম্বর রিজেন্ট গ্রোভের ‘শ্রীমতি’ বাড়িটিতে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। বাড়িতে ঢুকতেই পাশে নিয়ে বসিয়েছিলেন। বুলা বৌদিকে ডেকে বলেছিলেন, ‘মা, বাংলাদেশ থেকে আমার ছেলে ইকবাল এসেছে, তার জন্য জলখাবার নিয়ে এসো।’ তিনি বারান্দায় বসে তরকারি কুটছিলেন। বললাম, ‘মাসিমা আপনি এই বয়সে তরকারি কুটতে পারেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আরে তোমাদের বয়সী মেয়েদের আমার সঙ্গে লাগিয়ে দাও না, দেখি কে আগে পারে!’ আমি পুরোনো দিনের গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করি। কানন দেবীরও গাওয়া বেশ কিছু রেকর্ড আমার কাছে আছে। বললাম, আপনার গাওয়া প্রায় ৫০-৬০ খানা গান আমি আমার সংগ্রহে রেখেছি। শুনে হেসে বললেন, ‘আরে পাগল ছেলে, কত বড় বড় শিল্পী আছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে আমার গান কষ্ট করে সংগ্রহ করে কী করবে?’
তাঁর দিকে তাকাই আর ভাবি, অতি সাধারণ বাঙালি এক বালিকা, যার নাম ছিল কাননবালা দাস, পরবর্তী সময়ে তাঁর কানন দেবীতে উত্তরণ এক কল্পকাহিনির মতো। রূপ, ব্যক্তিত্ব আর গুণের এমন ত্রিবেণী সঙ্গম খুব কম ভারতীয় অভিনেত্রীর মধ্যেই দেখা গেছে। তাঁকে একটু ছোঁয়ার জন্য প্রেক্ষাগৃহে পর্দার দিকে দর্শক ছুটে গিয়েছে, যে রাস্তা দিয়ে তিনি ফিটন গাড়িতে চড়ে যেতেন সে রাস্তার ধারে তাঁকে এক পলক দেখার জন্য কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে থেকেছে।
কানন দেবী
কানন দেবীর বাবা রতন চন্দ্র দাস মেয়েকে গান শেখাতে চেয়েছিলেন। কানন দেবীরও সাধ ছিল গায়িকা হওয়ার। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর নিষ্ঠুর নিয়তি কানন দেবী আর তাঁর বিধবা মাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিক্ষেপ করল। জীবনে অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন তিনি কখনো দেখেননি। বাঁচার অবলম্বন হিসেবে যখন অভিনয়কে বেছে নিতে হলো, তখন অভিনয়কেই তিনি তাঁর জীবন, জীবিকা, ধ্যান ও জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে গানকে তিনি অবহেলা করেননি।
তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কানন দেবী কাকাবাবু বলে ডাকতেন। তিনিই তাঁকে মাত্র দশ বছর বয়সে ম্যাডান কোম্পানিতে নিয়ে আসেন। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি জয়দেব-এ রাধার ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে কানন দেবীর শিল্পীজীবন শুরু হলো। ১৯২৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। এরপর ১৯২৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ইন্ডিয়ান সিনেমা আর্টস’ প্রযোজিত এবং কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত নির্বাক ছবি শঙ্করাচার্য ছবিতে বালিকা কানন অভিনয় করেন। ১৯৩১ সালে প্রথম সবাক বাংলা ছায়াছবি জামাইষষ্ঠী মুক্তি পেল। ‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য সবাক ছবি জোরবরাত-এর জন্য সুন্দরী ও সুকণ্ঠী নায়িকার প্রয়োজন। ছবির পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় কাননকে ডেকে পাঠালেন। কানন দাস নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করলেন মিস কাননবালা নামে। এরপর ১৯৩১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঋষির প্রেম, প্রহ্লাদ এবং ১৯৩২ সালে বিষ্ণুমায়া ছবিতে অভিনয় ও গান করেন। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। ১৯৪১ সালে নীতিন বসু পরিচালিত পরিচয় ও এই ছবির হিন্দি সংস্করণ লগন-এ নায়িকা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বিএফজেএ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে সম্মানিত করে। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার পান। ১৯৯০ সালে তিনি সিনে সেন্ট্রাল কর্তৃক হীরালাল সেন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯১ সালে কানন দেবী ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি পুরস্কার পান। কানন দেবীর গাওয়া ‘আমি বনফুল গো‘, ‘তুফান মেল’ অথবা রবীন্দ্রসংগীত ‘আজ সবার রঙ্গে’ বা ‘তার বিদায়বেলার মালাখানি’ গান একবার যাঁরা শুনেছেন তাঁরা অনায়াসে বুঝবেন যে গায়িকা হিসেবে তিনি কত উঁচুদরের শিল্পী ছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই তিনি আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের অন্তরে তিনি পেয়েছেন চিরস্থায়ী আসন।

No comments

Powered by Blogger.