জাদুকর রোনালদোয় বশ ‘বিদ্রোহী’ ভলফসবুর্গ

শেষ পর্যন্ত রোনালদোই হয়ে দাঁড়ালেন পার্থক্যটা
প্রথম লেগে ভলফসবুর্গের মাঠে হারের ব্যবধান ছিল ২-০। আগের ৩২ বারের ২৬ বারই চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ চারে খেলা রিয়াল মাদ্রিদের আগের কৃতিত্বের পুনরাবৃত্তি করতে ঘরের মাঠের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে জিততে হতো ৩-০ গোলে। কাজটা ছিল কঠিন, অনেকের চোখে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করাই তো তাঁর কাজ। রিয়ালের টিকে থাকার, বেঁচে থাকার, নিজেদের নামের মর্যাদা রক্ষার যে তিনটা গোল দরকার ছিল, গুণে গুণে তিনটাই এনে দিলেন রোনালদো। ফিরতি লেগে নিজেদের মাঠে ভলফসবুর্গকে ৩-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেল রিয়াল। রোনালদোর জ্বলে ওঠার দিনে কোনো কাজই ‘অসম্ভব’ কিংবা ‘কঠিন’ নয়, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। রোনালদো জ্বলে উঠলেন একেবারে ঠিক সময়ই। ম্যাচের শুরুতেই দুই মিনিটের মধ্যে দুই নিখুঁত ফিনিশিংয়ে প্রথম লেগে ২-০ গোলের অবিশ্বাস্য হারের, সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হওয়ার হারের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিলেন। ১৬ আর ১৭ মিনিটের দুই গোলেই রিয়াল ম্যাচের শুরুতেই প্রথম লেগ শেষে মনে হওয়া ‘বিশাল শূন্যতা’ একেবারেই মিটিয়ে ফেলল। ৭৭ মিনিটে দুর্দান্ত এক ফ্রি কিক নিশ্চিত করল, খেলা ৯০ ​মিনিটেই শেষ হচ্ছে। এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে ১০ ম্যাচে ১৬ গোল, নিজের গড়া রেকর্ডটাই আবার ভেঙে দিতে চলেছেন মৌসুমের একেবারে ঠিক সময়ে জ্বলে ওঠা এই পর্তুগিজ। আর তাতেই এ নিয়ে টানা ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ চারে পৌঁছাল দশবারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল। নিজেদের মাঠে ভলফসবুর্গ রিয়ালের ওপর যেমন চড়াও ছিল, কাল সান্তিয়াগো বার্নাব্যু যেন ছিল ততখানিই নিষ্প্রভ। ম্যাচের ১৬ মিনিটেই দানি কারভাহালের ক্রসে পা ছুঁইয়ে রিয়ালকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন রোনালদো। আনন্দের রেশ কাটতে দেননি রোনালদো, বরং দলের আনন্দ আর প্রত্যাশাকে দ্বিগুণ করেই পরের মিনিটে দলকে এগিয়ে দেন ২-০ গোলে, জোরালো হেডে গোল করে। প্রথম থেকেই খোলসের মধ্যে ঢুকে থাকা ভলফসবুর্গ এরপর যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ম্যাচে পরের ৩০ মিনিট দাপট দেখায়। চারটি গোলের সুযোগও তৈরি করে। কিন্তু শুরুতেই রোনালদো যে ধাক্কা দিয়েছেন, সেটি আর সামলে উঠতে পারেনি জার্মান ক্লাবটি। জয় নিশ্চিত করা ফ্রি কিকটাও হলো দুর্দান্ত। বক্সে দাঁড়ানো ওভালকে আক্ষরিক অর্থেই যেন ‘ভেদ’ করলেন রোনালদো, ডান পায়ের আগুনে শটে। প্রথম লেগে ২-০ গোলের জয় দিয়ে ‘ছোট’ দল ভলফসবুর্গ যে বিদ্রোহের দুর্গ গড়েছিল ইতিহাসের অন্যতম বড় ক্লাবটির বিপক্ষে, সেটাই যেন রোনালদো-গোলায় দুমড়ে-মুচড়ে একেবারে ধুলো! ম্যাচ শেষে নিজের ক্যারিয়ারের ৩৫তম হ্যাটট্রিকের বন্দনাটা বেশ ভালোই উপভোগ করছিলেন রোনালদো। সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন, ‘এই মৌসুমটা আমার ভালো যাচ্ছে না বলছেন অনেকেই। যারা এভাবে বলছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলছি, মৌসুমটা আমার একেবারেই খারাপ কাটেনি।’ সমালোচনাকে পাত্তা দেন না—এ কথা বলেননি। বরং সমালোচনা যে তাঁকে তাতিয়ে দেয়, সেটা তাঁর পরিসংখ্যানই জানিয়ে দেয় বলে অভিমত রোনালদোর, ‘যে কেউই আমার সমালোচনা করতে পারে। আমার তো সমালোচকের অভাব নেই। কিন্তু এই সমালোচনা সত্ত্বেও আমি কেবল এগিয়ে যেতেই পছন্দ করি। দিন শেষে আমার নামের সঙ্গে যে পরিসংখ্যান দেখা যায়, আমার এগিয়ে যাওয়ার নমুনা ওটাই।’ ভলফসবুর্গের বিপক্ষে তাঁর এই হ্যাটট্রিক একেবারে খাদের কিনারা থেকে তুলে নিয়ে এল রিয়ালকে। এই রাতটাই তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ‘রাত’ কি না, এমন প্রশ্নে রোনালদোর জবাব, ‘আজকের রাতটা সবচেয়ে সেরা যদিও নয়, কিন্তু অন্যতম সেরা বলাই যায়।’ গোল করার ব্যাপারটি যে তাঁর ডিএনএর মধ্যে আছে, সেটাও সংবাদ সম্মেলনে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি গোল করতে পছন্দ করি। গোল করার ব্যাপারটা আমার ডিএনএতে। আমি কেবলই দলের জন্য গোল করে যেতে চাই। একটার পর একটা।’ জিনেদিন জিদান নিজে কিংবদন্তি। মাঠে এমন অসংখ্য রূপকথার জন্ম দিয়েছেন। তিনিও যেন ভাষা খুঁজে পেলেন না, ‘রোনালদো সম্পর্কে কী-বা বলব? সে তো প্রমাণ করে দিয়েছে যে সে ভলফসবুর্গের সঙ্গে রিয়ালের পার্থক্য গড়ে দেওয়া খেলোয়াড়।’

No comments

Powered by Blogger.