বৈশাখী ব্যবসা বাড়ছে by শুভংকর কর্মকার

রাজধানীর বাইরে রিকশাভ্যানে বৈশাখের কেনাকাটা। গতকাল দুপুরে
মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর এলাকায় ছোটদের পোশাক কিনছেন এক নারী
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে কেনাকাটার উৎসব চলছে। সাধারণ মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে উৎসবটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও মিশেছে। ফলে কেবল পোশাক কেনাবেচা বর্ষবরণের ব্যবসা-বাণিজ্যে আটকে নেই, বরং পরিধি বেড়েছে। প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখী ভাতা পেয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ভাতা দিতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বৈশাখকেন্দ্রিক ছোট অর্থনীতির আকারটি ধীরে ধীরে বাড়ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য–পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ধারণা, পয়লা বৈশাখে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উৎসব ভাতা ইত্যাদি কারণে এবারের বৈশাখী ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালো হচ্ছে। অবশ্য টাকার অঙ্কের গণ্ডির মধ্যে বৈশাখের অর্থনীতিকে আবদ্ধ করতে চান না বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ। তিনি গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ ঘিরে দেশের ঐতিহ্যবাহী বহু পণ্যের চাহিদা ও জোগান বেড়ে যায়। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প উপকৃত হয়। চাঙা ভাব আসে। অন্যদিকে ঈদের সময় ভারতীয় পোশাক দেদার বিক্রি হয়। তবে নববর্ষের সময় বিক্রি হওয়া ৯৯ শতাংশ পোশাকই দেশি। তাই শুধু টাকার অঙ্কে বৈশাখের প্রভাব বিচার করা যুক্তিসংগত না।’ দুই বছর আগে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বলেছিল, রোজার ঈদে সারা দেশে ৭০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এমন তথ্য জানিয়ে নাজনীন আহমেদ বলেন, বর্ষবরণ উৎসবটি সর্বজনীন। সব ধর্মের মানুষই উৎসবটি উদ্যাপনে কেনাকাটা করে। এ ছাড়া গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে অনেক জায়গায় বৈশাখী মেলা হয়। এতে দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের পণ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল। তবে অর্থের পরিমাণটি একেবারে কম হবে না। রাজধানীতে থাকা মানুষের মধ্যে বৈশাখী পোশাক কেনার আগ্রহ বেশি থাকায় বুটিক ও ফ্যাশন হাউসগুলো তিন-চার মাস আগ থেকেই প্রস্তুতি নেয়। মাস খানেক আগে থেকেই নিত্যনতুন নকশার পোশাক প্রদর্শন শুরু করে। কয়েক বছর আগেও বৈশাখের আগে সপ্তাহ খানেক ফ্যাশন হাউসের ব্যবসা হলেও বর্তমানে পুরো চৈত্র মাসই হয়। ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতি (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ)। সমিতি চার বছর আগে একটি জরিপ করে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের ফ্যাশন হাউসে সারা বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। তার মধ্যে ৫০ শতাংশই হয় রোজার ঈদে। ২৫ শতাংশ হয় পয়লা বৈশাখে। বাকিটা সারা বছর। ফ্যাশন উদ্যোগের সভাপতি আজহারুল হক বলেন, ‘মানুষের মনে এবার স্বস্তি আছে। এ ছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে সরকারি কর্মকতা-কর্মচারীরা প্রথমবারের মতো উৎসব ভাতা পাওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্যাশন হাউস থেকে পোশাকসহ নানা উপহার কিনছে। আমাদের আশা, গতবারের চেয়ে এবার ২০ শতাংশ বেশি ব্যবসা হবে।’ সারা দেশে পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফ্যাশন হাউস আছে। তার মধ্যে ঢাকাতেই ৬০ শতাংশ। ফ্যাশন হাউসগুলোতে এবার নববর্ষের বেচাকেনা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা হবে বলে দাবি করলেন সভাপতি আজহারুল হক। এদিকে রাজধানীর পাশাপাশি বাইরের জেলাগুলোতে বৈশাখী পোশাকের বেচাকেনা ভালো হচ্ছে বলে জানালেন রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস। তিনি ফ্যাশন উদ্যোগের অর্থ পরিচালক। বললেন, ‘ঢাকার পাশাপাশি অন্য জেলা শহরের ফ্যাশন হাউসে ভালো ব্যবসা হচ্ছে খবর পাচ্ছি। গতবার কিন্তু এতটা সাড়া পাইনি আমরা। ব্যবসা এখন পর্যন্ত ভালো।’ এদিকে ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ না থাকলেও বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে গেছে পান্তা-ইলিশ। এ জন্য চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে কাঁচাবাজারে ইলিশ কেনার ধুম পড়ে যায়। অসময়ে ইলিশের চাহিদাকে পুঁজি করে দাম বাড়ান মাছ ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা গত সোমবার ১ কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের একেকটি ইলিশের দাম হাঁকেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। ১ কেজি ৫০-১০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ দুই হাজার টাকা। আর ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৪০০ টাকা। তবে ইলিশের বিকিকিনি কাঁচাবাজার ছাড়িয়ে সুপারশপেও ঠাঁই নিয়েছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তারা। অনলাইনভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠানও বিক্রি করছে এই ‘বৈশাখী ইলিশ’। নববর্ষের দিন এই পান্তা-ইলিশের ব্যবসাও জমে ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পান্তা-ইলিশের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয়। চড়া দামে পান্তা-ইলিশ খেয়ে তৃপ্ত হন অনেক নগরবাসী। হালখাতার চল অনেকটা ফিকে হলেও পুরান ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী নতুন খাতা খুলে বছর শুরু করেন। সেই সঙ্গে মিষ্টি নিমকি দিয়ে ক্রেতা ও বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়ন করার ঐতিহ্যটি এখনো টিকে আছে। অন্যদিকে বছরের প্রথম দিনটি ছুটি থাকলে পরদিন মিষ্টি খাওয়ার চল তৈরি হয়েছে অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠানে। ফলে মিষ্টির ব্যবসা বেশ ভালোই চলে। সুইটস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মাধব চন্দ্র ঘোষ বৈশাখে কত টাকার মিষ্টি বিক্রি হয় সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারলেন না। সমিতির কাছে এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে তিনি বললেন, ‘সাধারণ সময়ে যে পরিমাণ মিষ্টি বিক্রি হয় তার দ্বিগুণ হয় নববর্ষে।’ নতুন বছর। তাই শুভেচ্ছা জানাতে হবে। কার্ড ছাপিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর রেওয়াজটি ধরে রেখেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতারা। এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা মানুষজনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও বিষয়টিতে এখনো মরচে পড়েনি। এ ছাড়া নকশা করা কাগজের হাতপাখা ও রোদটুপি ছাপা হচ্ছে। তবে ক্যালেন্ডার ছাপানো কিছুটা কমেছে। সব মিলিয়ে মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলোর (প্রিন্টিং প্রেস) ব্যবসাও মন্দ না। শাহবাগের ডুয়েট অ্যাড নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কমল পাল বললেন, ‘বৈশাখী ব্যবসা ভালো হয়েছে। ১৫-১৬টি প্রতিষ্ঠানের ১০-১২ হাজার শুভেচ্ছা কার্ড ছাপিয়েছি। এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলমান থাকায় অনেক নেতার শুভেচ্ছা পোস্টার ছাপিয়ে দিয়েছি।’ বিআইডিএসের গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘বৈশাখী ভাতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ উৎসবকে সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ভাতা দিচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও দেবে। ফলে ভবিষ্যতে বৈশাখ ঘিরে মানুষের চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক বৃদ্ধি পাবে।’

No comments

Powered by Blogger.