পানামা পেপারস উইকিলিকস নয়

রুশ পত্রপত্রিকা ও ওয়েবসাইটগুলোর একটা অংশ বলছে, পানামা পেপারসের সাহায্যে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা ‘ইনফরমেশন ওয়ার’ বা প্রচারণাযুদ্ধ শুরু করেছে। তারা এটা বলছে এই কারণে যে পানামা পেপারস ফাঁসের প্রথম দিনেই ওয়াশিংটনের ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্শিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ও লন্ডনের গার্ডিয়ানসহ অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কর ফাঁকিবাজ, সম্পদ গোপনকারী ও টাকা পাচারকারীদের তালিকার একদম শীর্ষে রেখে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু পানামা পেপারসের নথিগুলোর কোথাও ভ্লাদিমির পুতিনের নাম নেই, নাম আছে তাঁর ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধুর। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে এই ‘মিথ্যা প্রচারণার উদ্দেশ্য রাশিয়াকে ভেতর থেকে দুর্বল করা, পশ্চিমের সঙ্গে তাঁকে আপসকামী করে তোলা। যদিও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রাশিয়াবিরোধী ইনফরমেশন ওয়ারের প্রসঙ্গটি মুখ্য হয়ে ওঠেনি, তবু ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্শিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) নামের প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তার বিরুদ্ধে ভাবাদর্শগত পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন। প্রধান অভিযোগ হলো, আইসিআইজে ও তার সহযোগী করপোরেট সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলো পানামা পেপারস ব্যবহার করে ‘সিলেকটিভ রিপোর্টিং’ করছে, এর ৯৯ শতাংশ গোপন রেখে মাত্র ১ শতাংশের ভিত্তিতে সাংবাদিকতা করছে। আরেকটা অভিযোগ হলো, তারা পানামা পেপারস সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করেনি, উইকিলিকসের মুখপাত্র ক্রিস্টিন হ্রাফনসনসহ প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাংবাদিকতার পক্ষের লোকজন আইসিআইজের কাছে দাবি করছেন, পানামা পেপারস নামে পরিচিত ১ কোটি ১০ লাখ নথির পুরোটা ‘সার্চএবল ফরম্যাটে’ অনলাইনে প্রকাশ করা হোক। কিন্তু আইসিআইজের ডিরেক্টর জেরার্ড রাইল ৪ এপ্রিল অয়্যারড ম্যাগাজিনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, তাঁরা তা করবেন না। তিনি এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববাসীকে জানাতে গিয়ে উইকিলিকসকে খোঁচা মেরে বলেছেন, ‘আমরা উইকিলিকস নই। আমরা দেখানোর চেষ্টা করছি যে সাংবাদিকতা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করা যায়।’ তার মানে তিনি বলতে চেয়েছেন, উইকিলিকস দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করে না। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা ও ‘সায়েন্টিফিক জার্নালিজম’ নামে এক নতুন পদ্ধতির সাংবাদিকতার প্রবক্তা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রতি এটা একটা বড় আঘাত বলে আমার মনে হয়। লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে তিন বছরের বেশি সময় ধরে গৃহবন্দী অ্যাসাঞ্জ অবশ্য এই আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা আঘাত করেননি। ৯ এপ্রিল দূতাবাসের ভেতরে আল-জাজিরার প্রতিনিধি রিচার্ড গিসবার্টকে দেওয়া মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কেউ যখন লাখ লাখ গোপনীয় নথি হাতে পায়, তখন তার কর্তব্য হয় সেগুলো অন্যদেরও পাওয়ার ব্যবস্থা করা। কারণ, শুধু যে কয়েক শ সাংবাদিকেরই সেগুলো নিয়ে কাজ করার আছে, তা তো নয়, আইনজ্ঞদেরও আছে, পুলিশ সদস্যদেরও আছে।’ অ্যাসাঞ্জ এ কথাও বলেছেন, পানামা পেপারস নিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনায় তিনি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছেন, পুতিন, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি পাশ্চাত্যবিরোধী পক্ষকে আক্রমণ করার সচেতন প্রবণতা কাজ করেছে, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না বলে তিনি মনে করেন। কয়েকটা প্রশ্ন জাগে: পানামার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার তথ্যভান্ডার থেকে ১ কোটি ১০ লাখ
গোপনীয় নথি চুরি বা হ্যাক করে জার্মানির দৈনিক সংবাদপত্র সুড্ডয়েশ সাইটুংকে যে ব্যক্তি দিয়েছেন (পরে পত্রিকাটি সেগুলো দিয়েছে আইসিআইজেকে), তিনি কী চেয়েছিলেন? সারা পৃথিবীর ধনাঢ্য কর ফাঁকিবাজ, সম্পদ গোপনকারী ও টাকা পাচারকারীদের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতেই তো? তাহলে তিনি নথিভান্ডারটি এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিলেন না কেন, যারা সেটা সরাসরি অনলাইনে প্রকাশ করত? তিনি যদি তা করতেন, তাহলে তো সারা পৃথিবীর সব সংবাদমাধ্যম সেগুলো ডাউনলোড করে সংবাদ রচনা করতে পারত। বাংলাদেশে আমরাও বের করতে পারতাম, পানামা পেপারসের কোনো নথিতে আমাদের দেশের কারও নাম-পরিচয় আছে কি না। থাকলে জানা যেত তাঁদের সংখ্যা কত, তাঁরা কত টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, কত কর ফাঁকি দিয়েছেন, কত সম্পদ কীভাবে লুকিয়ে রেখেছেন।
কিন্তু সে উপায় নেই। পানামা পেপারস আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে এবং আইসিআইজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা সেগুলো কোনো দিনই দেখতে পাব না। আইসিআইজে বলছে, তারা ১ কোটি ১০ লাখ নথি পেয়েছে, যাতে ১০০টি দেশের ৪০ বছরের অফশোর লেনদেনের তথ্য আছে। তারা বুক ফুলিয়ে দাবি করছে, ২.৬ টেরাবাইটের এই ইলেকট্রনিক তথ্যভান্ডার উইকিলিকসের প্রকাশ করা কেব্লগেট তথ্যভান্ডারের (১.৭৩ গিগাবাইট) তুলনায় দুই হাজার গুণ বড়। তাদের এই দাবির সত্যাসত্য যাচাই করার কোনো উপায় আমাদের নেই। তারা যা বলছে, তা-ই বিশ্বাস করতে হবে।
কিন্তু সংশয়বাদীরা প্রশ্ন তুলছেন। আইসিআইজের আচরণ যেন আরেক জবরদস্ত কর্তৃপক্ষের মতো, বিশাল এক গোপনীয় তথ্যভান্ডার ঘটনাক্রমে যাদের কুক্ষিগত হয়েছে। সেই তথ্যভান্ডার থেকে তারা কতটুকু প্রকাশ করবে আর কতটা গোপনেই রেখে দেবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একচেটিয়া অধিকার দৃশ্যত তাদেরই।
কেউ কেউ বলছেন, পানামা পেপারস নিয়ে আইসিআইজের ‘দায়িত্বশীল’ সাংবাদিকতার এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যাপূর্ণ দিক। ওয়াশিংটনভিত্তিক এই সাংবাদিক সংঘের ওয়েবসাইট বলছে, তারা নন-প্রফিট বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ফোর্ড ফাউন্ডেশন, ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন, কেলগ ফাউন্ডেশন, রকেফেলার ফ্যামিলি ফান্ডসহ এক ডজনের বেশি দাতব্য সংস্থার অর্থায়নে চলে। এসব সংস্থার অর্থও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে থেকে আসে না, যে পুঁজিবাদ পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেইম্যান আইল্যান্ড, আমেরিকার নেভাদা ও ডেলাওয়্যার অঙ্গরাজ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ট্যাক্স হেভেনের নামে কর ফাঁকি দেওয়া, সম্পদ লুকানো ও অর্থ পাচারের চমৎকার ব্যবস্থা ‘বৈধভাবে’ চালু রেখেছে যুগ যুগ ধরে। কাউন্টারপাঞ্চ ডটকমে ৬ এপ্রিল মার্গারেট কিম্বারলি মন্তব্য করেছেন, পৃথিবীর ১ শতাংশ ধনাঢ্য মানুষ নিজেদের নোংরা কাজগুলো গোপন রাখার জন্য আইনপ্রণেতাদের কিনতে পারেন, রাজনীতিকদের কিনতে পারেন, সংবাদমাধ্যমকেও কিনতে পারেন।
আইসিআইজের নেতৃত্বে পৃথিবীর প্রায় ১০০টি করপোরেট সংবাদপ্রতিষ্ঠান পানামা পেপারস নিয়ে যে সাংবাদিকতা করছে, তা প্রথাগত। কী প্রকাশযোগ্য, কী প্রকাশযোগ্য নয়, যা প্রকাশযোগ্য তার কতটা প্রকাশযোগ্য, প্রকাশযোগ্য তথ্যগুলোর মধ্যে কোনটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ—এ সবকিছুই নির্ধারণ করে সংবাদপ্রতিষ্ঠান।
জনগণ কী জানতে চায়, কী জানা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা নিজেরা মনে করে, সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কাছে এসব বিবেচ্য নয়। সংবাদপ্রতিষ্ঠান জনগণকে যা জানানো প্রয়োজন মনে করে, সেটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রথাগত সাংবাদিকতা বিশ্ববাসী বহু যুগ ধরে দেখে আসছে। (পানামা পেপারস নিয়েও এই সাংবাদিকতাই চলছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের প্রয়াত বাবার কর ফাঁকি দেওয়া এবং বাবার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রীর লাভবান হওয়ার খবরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বন্ধুর সম্পদ লুকানোর খবর।)
এই প্রথাগত সাংবাদিকতায় অতি সাম্প্রতিক কালে যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে তা হলো, ইলেকট্রনিক হুইসলব্লোয়ার ও সাইবার অ্যাকটিভিস্ট হ্যাকার বা হ্যাকটিভিস্টদের অবদান। সাংবাদিকেরা হ্যাকার নন, কোনো প্রতিষ্ঠানের গোপনীয় নথিভান্ডার হ্যাক (ইলেকট্রনিক উপায়ে চুরি করা) করার প্রযুক্তিজ্ঞান ও দক্ষতা তাঁদের নেই, সেটা তাঁদের কাজও নয়। কিন্তু হুইসলব্লোয়ার ও হ্যাকটিভিস্টরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সাংবাদিকদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসছেন। তাঁরা চান সংবাদমাধ্যমগুলো প্রথাগত সাংবাদিকতার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করুক। এই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ ও ইন্টারনেট নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছেন সবচেয়ে কার্যকর পন্থায়। উইকিলিকস নামে এমন এক অভূতপূর্ব অনলাইন ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলেছেন, যা এ পর্যন্ত অভেদ্য ও অদম্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
অ্যাসাঞ্জ সাংবাদিক নন, কিন্তু নতুন যুগের সাংবাদিকতার একটা দর্শন ও প্রায়োগিক ফর্মুলা তিনি হাজির করেছেন। আফগান ওয়ার লগ, ইরাক ওয়ার ডায়েরি, আমেরিকান এমবাসি কেব্লস (কেব্লগেট), সিরিয়া ফাইলস, সৌদি কেব্লস, স্পাই ফাইলস, হিলারি ক্লিনটন ই–মেইল আর্কাইভ, জন ব্রেনান ই–মেইলস, সোনি ফাইলস—আরও অনেক গোপনীয় নথিপত্র ‘উইকিলিকস ডট ওআরজি’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তিনি ‘সায়েন্টিফিক জার্নালিজম’ করার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ২০১০ সালে কেব্লগেট নিয়ে লন্ডনের গার্ডিয়ান, আমেরিকার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ফ্রান্সের লে মঁদ, জার্মানির ডের স্পিগেল ও স্পেনের আল পাইস-এর সঙ্গে উইকিলিকসের বিশেষজ্ঞ দল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের নেতৃত্বে সায়েন্টিফিক জার্নালিজমের প্রথম নমুনা সফলভাবে দেখিয়েছে।
বিষয়টা ছিল এ রকম: আমেরিকান হুইসলব্লোয়ার চেলসি ম্যানিংয়ের কাছ থেকে উইকিলিকস কয়েক লাখ গোপনীয় নথি পেয়ে ওপরে উল্লিখিত চারটি সংবাদপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের সঙ্গে যৌথভাবে নথিগুলো বিশ্লেষণ করে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ধরা যাক, গার্ডিয়ান এক বা একাধিক নথির ভিত্তিতে একটা সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করে প্রকাশ করল। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রস্তাব করলেন, ওই প্রতিবেদনের পাশেই একটা লিংকও জুড়ে দেওয়া হবে, যেখানে ক্লিক করলে সংশ্লিষ্ট নথিগুলোর ইমেজ দেখা ও পড়া যাবে, ডাউনলোডও করা যাবে। এভাবে পাঠক নিজেই বিচার করে দেখতে পাবেন, সাংবাদিকেরা কতটা বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। সে সময় গার্ডিয়ান ও অন্য পত্রিকাগুলো এটা করেছিল। আর কেব্লগেটের পুরো ফাইল উইকিলিকসের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে বাংলাদেশেও আমরা অনেক প্রতিবেদন তৈরি করে পত্রিকায় ছেপেছিলাম; বেশ কিছু গোপনীয় মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তা বাংলায় অনুবাদ করে উইকিলিকসে বাংলাদেশ নামে একটা বইও প্রকাশ করেছিলাম।
পানামা পেপারস উইকিলিকসের হাতে কেন আসেনি—এটা দুঃখের সঙ্গে ভাবছি। আরও ভাবছি, অন্তরালের সেই হুইসলব্লোয়ার বা হ্যাকার তাঁর দেওয়া এই অমূল্য তথ্যভান্ডারের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে কি সন্তুষ্ট হচ্ছেন? নাকি এখন তাঁর এই ভেবে আফসোস হচ্ছে যে তথ্যভান্ডারটি করপোরেট মিডিয়াকে দেওয়া বিরাট এক ভুল হয়েছে? প্রথাগত সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর এ রকম নিরাপদ ও ‘সিলেকটিভ’ সাংবাদিকতা দেখে ‘মহৎ আদর্শবাদী’ হ্যাকটিভিস্ট ও হুইসলব্লোয়াররা হতাশ হচ্ছেন না তো?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.