ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে উন্নত মানের ইটভাটা by বিয়ন লোমবোর্গ

বিয়ন লোমবোর্গ
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথমআলো। আজ প্রকাশ করা হলো চতুর্থটি। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটিতে পরিণত হয়। বছরের এই সময়ে বায়ুদূষণের মাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত মানের চেয়ে ১৩-১৬ গুণ বেশি বেড়ে যায়। রাজধানীতে বায়ুদূষণ কমাতে হবে—এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই বায়ুদূষণ মোকাবিলায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তাতে জাতীয় বাজেট এবং দাতাদের ও সাধারণ নাগরিকেদের কাছ থেকে পাওয়া তহবিলে টান পড়বে। এসব অর্থ অন্যান্য আরও কল্যাণমূলক কাজের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। বাইরের বায়ুদূষণের মোকাবিলা করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশ কঠিন হয়। কারণ, নানা উৎস থেকে এই দূষণ ঘটে। কিন্তু ঢাকার পরিস্থিতি ব্যতিক্রম, এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ ঘটে ইট উৎপাদনের কারণে। প্রতিবছর নির্মাণকাজের জন্য ঢাকার এক হাজারেরও বেশি ভাটা ৪০০ কোটি ইট তৈরি করে। এই ইটভাটাগুলো রাজধানীতে ৪০ শতাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, যা প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে। আর যেহেতু ইট শুধু শুষ্ক মৌসুমেই উৎপাদন করা যায়, সেহেতু ইটভাটাগুলো বছরের এই সময়টিতে বায়ুদূষণের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়। বেশির ভাগ ইট প্রস্তুতকারক স্থায়ী চিমনি নামে পরিচিত ভাটা ব্যবহার করে থাকেন, যেগুলো জ্বালানি অপচয়কারী, উচ্চমাত্রায় দূষণকারী ও নিম্নমানের কয়লা পোড়ায়। বায়ুদূষণ কমানোর জন্য হয় ভাটাগুলোকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রতিস্থাপন করতে হবে অথবা সেগুলোর সংস্কার করতে হবে। আমাদের গবেষণায় একটি সাধারণ সংস্কারের মাধ্যমে ভাটাগুলোকে ‘আঁকাবাঁকা’ আকৃতি প্রদান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা অনেকটা হাইব্রিড হফম্যান ভাটার মতো দেখতে হবে। হাইব্রিড হফম্যান ভাটাগুলো পরিবেশবান্ধব হলেও এ ধরনের একটি ইটভাটা তৈরিতে খরচ পড়ে ১৬ কোটি টাকা। সে তুলনায় একটি বিদ্যমান স্থায়ী চিমনির ভাটাকে সংস্কার করে আঁকাবাঁকা আকৃতির ভাটায় রূপান্তর করতে ৪০ গুণ কম খরচ পড়বে। যদি এ ধরনের আঁকাবাঁকা বা জিগজ্যাগ আকৃতির ভাটা ঢাকাজুড়ে ব্যবহৃত হতো, তাহলে বায়ুদূষণের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমে যেত। ভাটার পরিচালনা খরচ বাবদ এতে বার্ষিক প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হবে, কিন্তু উপকার হবে অপরিসীম। শুধু স্বাস্থ্য খাতেই বার্ষিক লাভ ১৭০ কোটি টাকার সমপরিমাণ হবে। কার্বন নিঃসরণ কমে যাওয়ার ফলে আট কোটি টাকার কল্যাণ বয়ে আনবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত ভাটা পরিচালকেরা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা পাবেন, যেমন উন্নতমানের ইট ও নিম্ন জ্বালানি খরচ। সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারী ও মালিকদের মুনাফায় অতিরিক্ত ১৪০ কোটি টাকা যোগ হবে। একটি স্থায়ী চিমনির ভাটাকে জিগজ্যাগ আকৃতির ভাটায় রূপান্তর করতে তিন মাস সময় লাগে এবং প্রতি ভাটায় খরচ হয় ৪০ লাখ টাকা। উন্নত ভাটাগুলো আরও কার্যকরভাবে ইটকে উত্তপ্ত করে, কারণ গরম বাতাস আঁকাবাঁকাভাবে ইটের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এই ভাটাগুলো জ্বালানি খরচ এক-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়, যে কারণে মালিক তাঁর বিনিয়োগকৃত অর্থ চার বছরেরও কম সময়ে তুলে ফেলতে পারেন। উন্নত মানের নকশার কারণে জিগজ্যাগ আকৃতির ভাটাগুলো উন্নত মানের ইটও প্রস্তুত করে, যা বেশি দামে বিক্রি করা যায়, আর এ কারণে ইটভাটার ব্যবসায়ীদের কাছে এ ধরনের ভাটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সাভারের একটি ইটভাটার মালিক কাওসার আহমেদ। তিনি ২০১২ সালে তাঁর ইটভাটাকে জিগজ্যাগ আকৃতিতে রূপান্তর করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন কীভাবে উন্নত প্রযুক্তি অপচয় হ্রাস করে। তাঁর ভাষ্যমতে, আঁকাবাঁকা আকৃতিতে রূপান্তরের পর তাঁর ভাটায় প্রায় ৯০ শতাংশ উন্নত মানের ইট উৎপাদিত হচ্ছে। আগের ভাটায় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভালো মানের ইট উৎপাদিত হতো। হাইব্রিড হফম্যান ভাটার ব্যবহারও সামগ্রিকভাবে অনেক সুবিধা বয়ে আনে। ঢাকার সব ইটভাটাকে হাইব্রিড হফম্যান ভাটায় রূপান্তর করলে প্রতিবছর ২৫০ কোটি টাকার স্বাস্থ্যসুবিধা পাওয়া যাবে। উন্নত মানের ইট উৎপাদনের মাধ্যমে মালিকপক্ষের মুনাফা হবে ৮৬০ কোটি টাকা। তবে এতে তাঁদের বছরে ব্যয় হবে ৩৩০ কোটি টাকা। ইট উৎপাদন খাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে আরও অনেক কিছুই করা যেতে পারে। ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসা যেতে পারে। ভাটাগুলোকে জনসংখ্যা বেশি এমন এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে করে ঢাকা নগরীতে বায়ুদূষণের পরিমাণ কমতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.