একচোখা শোক ও আইএসের পেছনের হাত by ফারুক ওয়াসিফ

গত রোববার লাহোরের গুলশান-ই-ইকবাল পার্কে
হামলা চালায় তালেবান জঙ্গি। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের
ইস্টার সানডে উপলক্ষে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল পার্কটিতে।
ওই হামলায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২ জন
কিছু মানুষ বেশি মানুষ, কিছু মানুষ কম মানুষ! কিছু মৃত্যু শোকের আর কিছু মৃত্যু নিছকই খবরের কাগজের কালো কালো অক্ষরের বিবরণ। অথচ সবার অশ্রুই সমান নোনা, সব স্বজনহারারই শোক অসহনীয়। ব্রাসেলসের জন্য আমরা মর্মাহত, প্যারিসের জন্য কেঁদেছি, কিন্তু লাহোরের জন্য কাঁদছি না, মোম জ্বালাচ্ছি না জাকার্তা, ইস্তাম্বুল, বাগদাদ বা সানার জন্য। বদলাচ্ছি না ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার। অভিযোগটা কাকে করছি? করছি প্রভাবশালী পশ্চিমা গণমাধ্যমকে, তাদের রাষ্ট্রনেতাদের। যে হরিণের এক চোখ কানা, সে সরল পথে ছুটতে পারে না। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদী বোমার বিষয়ে সরল সত্যটাও তাই তারা দেখতে চায় না বা দেখাতে চায় না। গত সপ্তাহে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বোমা হামলায় নিহত হলেন ৩০ জন নিরীহ মানুষ। পরপরই পাকিস্তানের লাহোরে একই ধরনের বোমা হামলায় নিহত হলেন ৭২ জন, এর মধ্যে ২৯ জনই শিশু। সব সন্ত্রাসবাদীই যেমন জঘন্য অপরাধী, তেমনি তাদের সব বেসামরিক শিকারই শোকযোগ্য জীবনের অধিকারী। তার পরও বিশ্ব মিডিয়ায় ইয়েমেন নিয়ে কথা কম। ২০১৫ সাল থেকে সেখানে সৌদি আরবের হামলা, সৌদি মদদপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও আইএসের হামলায় প্রায় সাত হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সৌদি আরব যেহেতু ইউরো-মার্কিন পরাশক্তির জানপাসন্দ রাষ্ট্র, সেহেতু এই মৃত্যুগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় হইচই নেই। বিশ্বে এখন নতুন শক্তি হয়ে উঠেছে আইএস। বেশির ভাগ বোমা হামলার পেছনে আইএসের হাত আবিষ্কার করা যাচ্ছে। কিন্তু আইএসের পেছনে কারা, সেই প্রশ্নটা কি ততটা জোরালোভাবে ওঠে? আইএসের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইসরায়েল ও আরবের রাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর সরাসরি ও পরোক্ষ মদদ থাকার অকাট্য অভিযোগ আছে। তবু চোখে ঠুলি পরে আইএসের বিরুদ্ধে সত্যিকার কোনো লড়াই চালায়নি বিশ্বশান্তির মোড়লেরা। কারণ, ইরাক থেকে সিরিয়া পর্যন্ত এলাকার মানচিত্র নতুন করে দাগানোর খোয়াবে মত্ত পাশ্চাত্যের আইএসকে দরকার। বাঘের আগে আসে ফেউ, ন্যাটোর অগ্রবর্তী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েছে আইএস। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রাশিয়া সত্যিকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বটে, তবে তার পেছনেও মহানুভবতা ছিল না, ছিল ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত ছড়ানো রণাঙ্গনে নিজের দাপট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা।  আইএস যতই রহস্যময় গুপ্তশক্তি হোক, আন্তর্জাতিক শক্তির মদদ, প্রশিক্ষণ ও রক্ষাকবচ ছাড়া তাদের পক্ষে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং আইএস দমনের নামে ইউরোপ অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারবিরোধী পথ নিলে শুধু ইউরোপীয় সংহতিই নষ্ট হবে না, বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক হানাহানি অভূতপূর্ব স্তরে উঠবে। আইএসের ষড়যন্ত্রের গোড়া রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধমুখী গোয়েন্দানীতিতে। আরেকটি গোড়া হলো মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার অদম্য বাসনা। একেকটি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটে আর ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো আরও মুঠো শক্ত করে। ব্রাসেলসে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ‘নব্য ফ্যাসিবাদী’ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পের পালে আরও হাওয়া এসে লাগে। প্যারিসে হামলার পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। প্যারিসে হামলার এক দিন আগে ফরাসি জরিপ সংস্থা আইএফওপির একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয় প্রখ্যাত লা ফিগারো পত্রিকায়। ওই জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আবশ্যকীয় সংস্কার বাস্তবায়নে ফরাসিরা অগণতান্ত্রিক ধরনের সরকার মেনে নেবে কি না? ৬৭ শতাংশ অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাটের পক্ষে বলেছেন। ৪০ শতাংশের পছন্দ অনির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী সরকার। শার্লি এবদোর একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ফরাসি জনমতকে কতটা বদলে দিয়েছিল, এই জরিপ তার ইঙ্গিত দেয়। প্যারিস হামলার পর থেকে ব্রাসেলসেও চলছিল নাগরিক অধিকার কর্তন এবং মুসলমান ও অভিবাসীদের তাড়িয়ে বেড়ানোর পুলিশি কার্যক্রম। নতুন বোমা হামলার পর এই পরিস্থিতি আরও তুঙ্গে ওঠার ভয় বাড়ল। জঙ্গিবাদের অভিশাপ দ্বিমুখী। জঙ্গি হামলার পর অনেক ‘সভ্য’ মানুষও প্রতিহিংসায় অন্ধ হন। তেমনি নিপীড়িতদের মধ্যে জন্ম দেয় আরও বেশি জঙ্গিত্ব। এবং পরিণামে দুইয়ে মিলেই মানবিকতা, ন্যায় ও সত্যের সম্ভাবনা ধ্বংস করে। অশুভ জঙ্গিবাদের শক্তিটা এখানেই যে তা আক্রান্তকে যেমন চরমপন্থার পথে টেনে নিয়ে যায়, তেমনি হতাশ ও বঞ্চিতদেরও জঙ্গিবাদের দিকে টানে। এই দুইয়ের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার দায় সবার। বিশ্বের দেশে দেশে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ফাটল বাড়ছে। একদিকে সিরীয়-লিবীয় শরণার্থীদের ঢল, অন্যদিকে ইউরোপীয় মুসলিম নাগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে মৌলবাদী শ্বেতাঙ্গরা ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত। একসময় যেভাবে ডানপন্থীরা ইহুদিদের ইউরোপের অভিশাপ ঘোষণা করে বিতাড়ন করতে চেয়েছিল এবং সেই বিদ্বেষ পুঁজি করে হিটলারের নাৎসি পার্টি ইহুদিনিধনকে জায়েজ করতে লেগেছিল; ইউরো-মুসলিমদেরও সে রকম দশায় যে পড়তে হবে না, তা কে বলতে পারে? বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতে মুসলিমদের সব নষ্টের গোড়া ভাবার লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। জঙ্গিবাদ যে ধর্মকেই অবলম্বন করুক না কেন, যতই তারা ধর্মের দোহাই দিক, তাদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ইহজাগতিক। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট পেপে ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঘটা প্রায় সব আত্মঘাতী বোমারুর‍-মোট সংখ্যা ৪ হাজার ৬ শর ওপর গবেষণা করে আসছেন।তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, গত ৩৬ বছরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানো বোমারুদের ৯৫ শতাংশই ছিল ‘সেক্যুলার’। তাদের লক্ষ্য ছিল কোনো না-কোনো সেনাবাহিনীর দখল ঠেকানো। ধর্ম এখানে ব্যবহৃত হয় নতুন বোমারুদের রিক্রুট করার জন্য (সূত্র: http://goo.gl/WIcNs2 )। ঠিক যে কারণে রাজনীতি ও ব্যবসায় ধর্মকে কাজে লাগানো হয়, জঙ্গিবাদীরাও সেভাবে ব্যবহার করে ধর্মকে। জঙ্গিবাদ-বিষয়ক আরেক গবেষক জানাচ্ছেন, আইএসের সদস্যরা ইসলাম নিয়ে মারাত্মকভাবে অজ্ঞ। সুতরাং, যাঁরা সন্ত্রাসবাদের জন্য ধর্মকে দায়ী করেন, তাঁদের নতুন করে ভাবা দরকার। তা দরকার জঙ্গিবাদের অভিশাপ মোকাবিলার স্বার্থেই। এটা বুঝে আসা দরকার যে ধর্মগ্রন্থের পাতা থেকে জঙ্গি পয়দা হয় না, জঙ্গি পয়দা করে নিপীড়ন ও আগ্রাসন। আশির দশকে আফগানিস্তানে রাশিয়ার এবং নব্বইয়ের দশকে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন না হলে আল-কায়েদা অথবা আইএসের জন্ম হতো না। এককথায়, অভিশপ্ত জঙ্গিবাদ পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী নীতিরই সন্তান, যার পিতৃত্ব তারা স্বীকার করতে নারাজ।

No comments

Powered by Blogger.