তোমরা এই ব্যভিচারী প্রেসিডেন্টের পক্ষে আছ কী করে?

স্বাধীনতার এই মাসে আজ থেকে ৪৫ বছর ৩ মাস আগে মাওলানা ভাসানীর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সম্পর্কে উচ্চারিত কয়েকটি বাক্য কানে এখনো অনুরণন হয়। সময়টা ১৯৭০ সালের নভেম্বর, স্থান খুলনা সার্কিট হাউস। কথাগুলো বলেছিলেন তিনি সে সময় যশোর-খুলনা অঞ্চলের সামরিক প্রশাসককে উদ্দেশ করে তাঁর এবং খুলনার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার শেষে। শুধু বাক্য বললে কথাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, মাওলানা ভাসানী সেদিন তাঁর বক্তব্যে জেনারেল ইয়াহিয়াকে যেভাবে ভূষিত করলেন বিভিন্ন উর্দু বিশেষণে, তার সব আমার পক্ষে বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে সেদিনের কথোপকথনের প্রেক্ষাপট আর সারাংশটুকু দিচ্ছি। সেদিন সেখানে আমি ছিলাম। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকাজে পাকিস্তান সরকারের অমার্জনীয় অবজ্ঞা ও অবহেলার জন্য শেখ মুজিবুররহমানের সঙ্গে আর যেসব জননেতা প্রচণ্ড প্রতিবাদ জানান, মাওলানা ভাসানী ছিলেন তাঁদের অগ্রগামী। তিনি শুধু পাকিস্তান সরকারের ত্রাণকাজে ব্যর্থতার প্রতিবাদ করেননি, তিনি এ অবজ্ঞাকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্যমূলক ব্যবহারের আরেকটা নজির হিসেবে উল্লেখ করেন। ঘূর্ণিঝড়ের পর মাওলানা ভাসানী উপদ্রুত এলাকা সফর করেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভায় ভাসন দেন। এক জনসভায় তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোকে অবহেলার জন্য দায়ী করেন এবং বলেন, এ ধরনের আচরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যেতে পারে। এটা হয়তো শুধু হুমকি ছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকার বিশেষভাবে সামরিক গোষ্ঠী মাওলানা ভাসানীর বক্তব্যে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এর একটি প্রধান কারণ ছিল আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, যা ইয়াহিয়া সরকার পরবর্তী মাসে ঘোষণা করেছে। ভাসানীর এ বক্তব্য নির্বাচনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে, তার চেয়ে আরও খারাপ, নির্বাচন বন্ধও করে দিতে পারে—এ আশঙ্কায় সামরিক সরকার ভাসানীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে ভাসানীর বক্তৃতার পরপর। আমি তখন খুলনায় শিক্ষানবিশ সহকারী কমিশনার, জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে প্রশাসন, ম্যাজিস্ট্রেসি ইত্যাদি সম্পর্কে সবে শিখছি। সারা দিন খুলনা কালেক্টরেটে কাটিয়ে সন্ধ্যায় খুলনা ক্লাবে গিয়েছি বিলিয়ার্ড খেলার জন্য। হঠাৎ ক্লাবের এক বেয়ারা এসে বলল, জেলা প্রশাসক আমাকে ফোন করেছেন। ফোন ধরতেই জেলা প্রশাসক বললেন তাড়াতাড়ি খুলনা সার্কিট হাউসে চলে আসতে। তিনি সেখানে আছেন, জরুরি কাজ আছে। আমি ফোন রেখে তড়িঘড়ি সার্কিট হাউসের দিকে ছুটলাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না সন্ধ্যায় জরুরি কাজ কী থাকতে পারে, বিশেষ করে আমার মতো শিক্ষানবিশের জন্য। এটাও অবাক লাগছিল যে জেলা প্রশাসক নিজের বাংলো থেকে ফোন না করে সার্কিট হাউস থেকে ডাকছেন, কারণ সার্কিট হাউস তখন সামরিক আইন প্রশাসনের দপ্তর হিসেবে কাজ করত। সার্কিট হাউস পৌঁছে দেখি, জেলা প্রশাসক অপেক্ষা করে আছেন, আর তাঁর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ও সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার দুররানি। ব্রিগেডিয়ার দুররানিকে আমি আগেও দেখেছি, যশোর থেকে তিনি প্রায়ই খুলনা আসেন। খুলনা ক্লাবে প্রায়ই টেনিস খেলতে আসেন, আমিও তাঁর সঙ্গে খেলেছি। আমি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই জেলা প্রশাসক জানালেন আমাকে তলব করার কারণ, আর কী সেই জরুরি কাজ।
জেলা প্রশাসক জানালেন, মাওলানা ভাসানী সেদিন সন্ধ্যায় বরিশাল থেকে খুলনা আসবেন সড়কপথে রূপসা ফেরিঘাট দিয়ে। আমার কাজ রূপসা ফেরিঘাট থেকে মাওলানা সাহেবকে খুলনা সার্কিট হাউসে নিয়ে আসা, জেলা প্রশাসক ও সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে একটি জরুরি সাক্ষাৎকারের কথা বলে। আমি শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তিনি না আসতে চাইলে? তাঁকে কি গ্রেপ্তার করতে হবে? প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বললেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ পাঠাতাম, তোমাকে না। তোমাকে পাঠাচ্ছি মাওলানা সাহেবকে কৌশলে নিয়ে আসতে। তুমি আমার গাড়ি নিয়ে যাবে, ওটিতে তাঁকে নিয়ে আসবে। ব্রিগেডিয়ার দুররানি বললেন ইংরেজিতে, আমরা তোমার ওপর ভরসা করে আছি। অগত্যা রওনা হলাম রূপসা ফেরিঘাটের উদ্দেশে জেলা প্রশাসকের সরকারি গাড়িতে, পেছনে জিপে কিছু পুলিশ, যাতে বিপদ হলে তারা সামাল দিতে পারে। ফেরিঘাটে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত আটটা, গাড়ির চলাচল খুব কম। আমি সরাসরি ফেরিতে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেরিচালককে বললাম ওপারে নিয়ে সে যেন ফেরি চলাচল বন্ধ রাখে। এ ধরনের আদেশ পেয়ে ফেরিচালক হতভম্ব হলেও সঙ্গে পুলিশ দেখে সে ভাবল, আমি কেউকেটা। তাই বিনা প্রতিবাদে ওপারে ফেরি নিয়ে গেল। ওপারে পৌঁছে আমি গাড়ি আর কূলে তুললাম না। আমার আর পুলিশের জিপ ফেরিতেই থাকল। উদ্দেশ্য, আর কোনো গাড়ি যেন না উঠতে পারে। আর সেই সুযোগে ঘাটে পৌঁছানোর পর মাওলানাকে যেন আমি আমার গাড়িতে ওঠাতে পারি। কিন্তু এমনই কপাল, কিছুক্ষণ পর মাওলানা ভাসানী একটি ছোট গাড়িতে এলেন, যেটা তাঁর ড্রাইভার কসরত করে ফেরিতে তুলে ফেলল। আমার কৌশল কাজে লাগল না। অগত্যা গাড়ি ফেরিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভাসানীর গাড়ির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাঁকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম যে আমি তাঁকে খুলনায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে। এতে অত্যন্ত খুশি হয়ে ভাসানী গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার সঙ্গে হাত মেলালেন। আমার জীবনে এই প্রথম মাওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎ, কিছুটা অভিভূত। তবু সাহস করে বললাম, স্যার, আপনাকে জেলা প্রশাসক আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাতের খাবারের জন্য সার্কিট হাউসে, সঙ্গে গাড়িও পাঠিয়েছেন। এই বলে সামনের গাড়িটি দেখালাম। গাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাসানী জিজ্ঞেস করলেন জেলা প্রশাসকের নাম। বলতেই তিনি চিনলেন। ভাবলাম, আর কোনো চিন্তা নেই, তিনি আমার সঙ্গে যাবেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, সার্কিট হাউসের নিমন্ত্রণে আর কেউ আছেন কি না। আমি কিছু না ভেবেই বললাম ব্রিগেডিয়ার দুররানির কথা। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভাসানী পিছু ফিরে তাঁর গাড়িতে সটান উঠে পড়লেন। তিনি দরজা বন্ধ করার আগে আমি দৌড়ে তাঁর গাড়িতে পাশে বসে তাঁর হাত দুই হাতে ধরে বললাম, স্যার, দয়া করে একটু সার্কিট হাউস হয়ে যান। আমার ওপর জেলা প্রশাসক অনেক নির্ভর করে আছেন। আমার চাকরিজীবনের সবে শুরু। আমার মিনতির জন্য কি না জানি না, মাওলানা ভাসানী স্থির চোখে চেয়ে হেসে বললেন, চলো, তোমার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মোলাকাত করেই যাই, তবে ওই সরকারি গাড়িতে নয়, আমার গাড়িতে। বলে তিনি একটু সরে আমাকে জায়গা করে দিলেন। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আরও দুজন লোক ছিল, একজন সামনে, আরেকজন ভাসানীর ডান পাশে। আমি পাশে বসে চলতে চলতে আল্লাহকে শুকরিয়া জানালাম। সার্কিট হাউস পৌঁছানোর পর ভাসানীকে ভেতরে নিয়ে দেখি জেলা প্রশাসক অভ্যর্থনাকক্ষে নিজেই দাঁড়িয়ে, আর ব্রিগেডিয়ার দুররানি পাশে। দুজনই ভাসানীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হাত মেলালেন। পরে তাঁকে তাঁরা পাশের একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। আমাকে জেলা প্রশাসক বললেন অভ্যর্থনাকক্ষে অপেক্ষা করতে। পাশের কক্ষে মিটিং ঘণ্টা খানেক চলল। ঘরের ভেতর কথাবার্তা বেশ নিচু গলায় হচ্ছিল, তাই কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু শেষের দিকে ভাসানী জোর গলায় কথা বলছিলেন। আগের কথা যদিও শুনিনি, তাঁর শেষের কথা শুনে মনে হলো, তিনি ব্রিগেডিয়ারকে উদ্দেশ করে বলছেন খাঁটি উর্দুতে, ‘দেখো, পাকিস্তান বাঙালি মুসলমান নে বানায়া, উও পাকিস্তান তোড়না নেহি চাহতে, তোমহারা প্রেসিডেন্ট ইসকো তোড়না চাহতা হ্যায়। (বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান বানিয়েছে, তারা পাকিস্তান ভাঙতে চায় না, তোমার প্রেসিডেন্ট ভাঙতে চায়)।’ এই কথা বলতে বলতে দরজা খুলে ভাসানী বেরিয়ে আসেন, পেছন পেছন ব্রিগেডিয়ার দুররানি আর জেলা প্রশাসক। কিন্তু কথা তখনো তাঁর শেষ হয়নি।
মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী
ভাসানী তাঁর স্বভাবসুলভ আঙুল উঁচিয়ে উর্দুতে বলেন, এভাবে পাকিস্তান থাকবে না। তারপর সোজাসুজি ব্রিগেডিয়ার দুররানিকে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একজন ব্যভিচারী। তোমরা (সেনাবাহিনী) এ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ না কেন? তোমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা নেই? এ লোক শুধু মদখোরই নয়, অসৎ চরিত্র। এই লোকই পাকিস্তান ভাঙবে। ভাসানী বাইরে দাঁড়িয়ে আঙুল নাচাতে নাচাতে বলছেন আর আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম লাল মুখ করে ব্রিগেডিয়ার দুররানি তাঁর কথা শুনে যাচ্ছেন নীরবে। আর কথা না বাড়িয়ে ভাসানী যখন গাড়িবারান্দার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন জেলা প্রশাসক রাতের খাবারের কথা বললে তিনি জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, রাতে তিনি বেশি খান না, এবং এখন বিশ্রামের জন্য তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে যাবেন। আমি পেছনে পেছনে এলে তিনি বললেন, তাঁর সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই বলে তিনি তাঁর গাড়িতে উঠে গেলেন। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে জেলা প্রশাসক ও ব্রিগেডিয়ার দুররানি তাঁকে বিদায় দিলেন। সেদিন ব্রিগেডিয়ার দুররানি মাওলানা ভাসানীকে কতখানি বোঝাতে পেরেছিলেন জানি না, কিন্তু যেভাবে ভাসানী সামরিক সরকার আর তার প্রধানকে সম্বোধন করেছিলেন বিশেষ বিশেষণে (তার কয়েকটি শব্দ আমি বাদ দিয়েছি), তা থেকে এটাই বুঝেছিলাম, তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং ভাসানীই তাঁকে শুনিয়ে গেলেন। ব্রিগেডিয়ার দুররানি চলে যাওয়ার পর জেলা প্রশাসকও বাড়ি ফিরে যান। তাঁর মুখ দেখে তাঁকে আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি। বাকি সব ইতিহাস।

No comments

Powered by Blogger.