শেয়াল ও ভাঙা বেড়া by সৈয়দ আবুল মকসুদ

গ্রামীণ জ্ঞানীরা বলেছেন, শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখাতে নেই। শেয়াল বাঙালির চেয়ে কম ধূর্ত নয়। এবং শেয়াল বাঙালির মতোই প্রতিভাবান প্রাণী। একালের বাংলাদেশ যদি একটি ঘর হয়ে থাকে, তাহলে তার বেড়াটির বহু জায়গায় ভাঙা। এবং সবগুলো ভাঙা জায়গার খোঁজই শেয়ালেরা পেয়ে গেছে। মানুষ জানে যে নিঃস্বের হারানোর ভয় নেই। কিন্তু যার অগাধ সম্পদ, তার কিছু হারালেও ক্ষতি নেই। ডাকাত ও লুটেরারা রাহাজানি ও লুট করে কত আর নেবে, যার সম্পদ সীমাহীন। বাংলাদেশে আজ উপচে পড়ছে সম্পদ। তা থেকে যৎকিঞ্চিৎ কেউ হাতিয়ে নিলে দেশটির কিছুই আসে যায় না। যেমন চার হাজার কোটি টাকা। ওটা কিছু না। পিনাট (চিনাবাদাম)—নস্যি। পাঁচ হাজার কোটি টাকাও কিছু না। আর ৮০০ কোটি টাকা। সে তো হাতের ময়লা। বাংলাদেশ আজ ধনসম্পদে এতটাই পরিপূর্ণ যে তা থেকে কিছুটা হাতিয়ে নিতে পৃথিবীর চোরেরা বাংলার মাটিতে ঢুকে পড়েছে। দেশ-বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত কোনো রাজনৈতিক দলের তহবিল নয়, জনগণের টাকা নানা রকম বেড়ার ভাঙা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পুরুষ ও নারী শেয়ালদের হাতে। আমাদের মরমি কবি যে গেয়েছেন—‘আমার ঘরের চাবি পরের হাতে,’ কত দূরদর্শী ছিলেন তিনি। শুধু যে বাউল কবির ঘরের চাবি পরের হাতে ছিল তা-ই নয়, এখনকার বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে জাতির সবকিছুর চাবিই আজ পরের হাতে। নগদ টাকা হোক, সোনাদানা হোক, প্রাকৃতিক সম্পদ হোক, গোপনীয় তথ্য হোক—সবকিছুর চাবিই পরের হাতে। তাঁর দেশের পূর্ব দিকের অংশটির অবস্থা এমনটি হবে, তা অনুমান করে বাংলা ভাষার বৃহত্তম কবিও গেয়েছেন: ‘আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি—/ আমার যত বিত্ত, প্রভু, আমার যত বাণী।।’ কবির ছিল মাত্র একজন প্রভু, বাংলাদেশের প্রভু যে কতজন, তা আমাদের সুযোগ্য পরিসংখ্যান দপ্তর পর্যন্ত বলতে পারবে না। বাংলাদেশের ধনদৌলত রাখার সিন্দুকগুলোর নকল ও ডুপ্লিকেট চাবি যে কত দেশে কতজনে কতগুলো বানিয়ে রেখেছে, তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। অত ডুপ্লিকেট চাবি সম্ভবত ঢাকায় যত তালাচাবি মেরামতকারী আছেন, তাঁরাও বানাননি। সেই সব চাবি দিয়ে তালা খুলে যার যা প্রয়োজন তা দুহাতে থলে ভরে নিয়ে গেলেও তা দেখার বা বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বর্তমান পৃথিবীতে চোর দুই প্রকার। একটি ছিঁচকে চোর বা পাতিচোর, অন্যটি মহাচোর। বাঙালি দুই ধরনের চুরিতেই দক্ষতার পরিচয় দেয়। ছিঁচকে চুরি এবং পুকুরচুরি। বাড়ির বাথরুমের বাল্বটা নষ্ট হয়ে গেছে। দোকান থেকে না কিনে ছুটির পর আসার সময় অফিসের একটা বাল্ব হাতব্যাগে নিয়ে দিব্যি হাঁটা দেওয়া হলো। গত ৪৫ বছরে বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত অফিস থেকে যত বাল্ব ও পানির কল চুরি হয়েছে, তার দাম দিয়ে হয়তো একটি ফ্লাইওভার বানানো সম্ভব। যদি অফিসের ভেতরের সেই ছিঁচকে চোরদের ধরে শাস্তি দেওয়া যেত, আজ ব্যাংকগুলো থেকে টাকা চুরি হতো না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও সুরক্ষিত থাকত। আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড় ধরা। বাঙালি জানে সে ধরা পড়বে না, পড়লেও শাস্তিটাস্তি কিছু হবে না। সুতরাং বিদ্যা হিসেবে যুক্তিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, জীববিদ্যা ও পদার্থবিদ্যার চেয়ে চুরিবিদ্যাই বড় বিদ্যা ও প্রধান বিদ্যা বাঙালির কাছে। বাঙালির চৌর্যবিদ্যার ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত গত কয়েক বছরে স্থাপিত হয়েছে। সব সমাজে সব বস্তু নেই। যেমন ধামা জিনিসটি বঙ্গদেশেরই নিজস্ব বস্তু এবং অতি প্রয়োজনীয় বস্তু। অন্যান্য দেশের ঝুড়িটুড়ি অনেক কিছুই আছে, কিন্তু ধামা নেই। এবং বঙ্গবাসীই একমাত্র জাতি, যে কিনা হাতে একটা ধামা নিয়েই চলাফেরা করে। কারণ কখন কোন নোংরা বা বিষ্ঠাজাতীয় কিছু চোখে পড়বে তা বলা যায় না, সেটা চাপা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হতে পারে ধামার। সেই থেকেই বাঙালির বাগ্‌ধারায় ধামাচাপা কথাটির উদ্ভব। একাত্তর থেকে আজ অবধি অনেক কিছুই আমরা ধামা দিয়ে চাপা দিয়েছি। এখনো দিচ্ছি। ভবিষ্যতেও দেব। ধামা ছাড়া আমাদের চলবে না। অতীতে বাংলাদেশ অনেক কিছুতেই রেকর্ড করেছে, যেমন দুর্নীতি। এবার তার মুকুটে যোগ হলো আর একটি কলঙ্কের পালক। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকেরটিই প্রথম। এর আগে আর কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে, তা জানা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকেরটিও জানা যেত না, কারণ আমাদের ধামা আছে, যদি ফিলিপাইনের দৈনিক দ্য ইনকোয়ারার ৮০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ ১০ কোটি ডলার মানি লন্ডারিং হওয়ার সংবাদ ফাঁস না করত। আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্টও ‘বানান ভুলের কারণে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা ব্যর্থ’ শিরোনামে গত ফেব্রুয়ারিতেই জানিয়েছিল যে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ কোটি ডলার চুরির উপক্রম হয়েছিল। ওই টাকা চুরি হলে বাংলাদেশের মুদ্রায় তা হতো ৮০০০ কোটি টাকা। সেটাই বা বেশি টাকা কী? ফিলিপিনো মায়া বেগম ও তার সহযোগী বন্ধুরা কোনো প্রস্তুতি ছাড়া এক দিনেই কী খেয়ালের বশে কাজটি করে ফেলেছে। প্রশ্ন জাগে, রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি যদি বিপরীত হতো, তাহলে কেমন দাঁড়াত। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা যদি কোনো বঙ্গসন্তান চুরি করে ঢাকায় ‌নিয়ে আসত এবং আমাদের কোনো পত্রিকা সে সংবাদ ফাঁস করে দিত, সেই চোরদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিত আমাদের প্রশাসন। তাদের বিচারে শুনানির জন্য আমাদের পার্লামেন্ট প্রকাশ্যে কী ব্যবস্থা নিত। মায়া বেগম গং ধরা পড়েছে এবং তাদের বিচার হচ্ছে এই জন্য যে ওই দেশে দক্ষ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন আছে। দায় সরকারকে নিতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের যে আমলাশ্রেণি, তারা থাকে নিরাপদে। তাদের সহযোগিতা অথবা কর্তব্যে অবহেলা ছাড়া চুরি হোক, জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ হোক, গোপনীয় তথ্য পাচার হোক—কিছুই সম্ভব নয় রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনায় বাংলাদেশের লজ্জায় ও দুঃখে ঘুম হারাম হওয়ার কথা। কিন্তু প্রবল উত্তেজনাবশত ব্যাংকের গভর্নর ও দুজন ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেওয়া হলো। তাতে কী বার্তা পেল বিশ্ববাসী? মুহূর্ত বিলম্ব না করে নিযুক্ত করা হলো নতুন গভর্নর। আমরা সাধারণ মানুষ আশা করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বিমানবন্দরে তিনি দেশবাসীকে আশার বাণী শুনিয়েছেন।  ঘটনাটি ঘটেছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কাঠগড়ায় খাড়া করার জন্য কোনো ত্রুটিই করছে না। নিজেরা নিজেরাই দুই-তিন পক্ষ। সব পক্ষেরই নিজস্ব মুখপত্র বা মিডিয়া আছে। বিশ্ববাসী সব পক্ষের কথাই শুনছে। এসব ঘটনায় বিরোধী দলের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা ‘খতিয়ে’ দেখলে নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া সম্ভব। কারণ আসমান ও জমিনে যা কিছু ঘটুক, বঙ্গীয় বিরোধী দলের হাত যদি নাও থাকে, পা তো থাকতে পারে। নানা রকম শেয়াল বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নানা রকম ভাঙা বেড়ার সন্ধান বহু আগেই পেয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে ব্যাংকের টাকা চুরির বহু ঘটনাই আমরা দেখেছি। এমন কিছু ঘটনা, যা আরব্য রজনীর কাহিনিগুলোকে হার মানায়। দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংকের মেঝে ফুটো করে বস্তা ভরে টাকা চুরি। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাউন্টার থেকে টাকার বান্ডিল হাতিয়ে নেওয়া এবং হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও আবার সেই ধামার ব্যাপার। ধামা আমাদের আছেই, শুধু চাপা দেওয়া। শেয়ারবাজার থেকে ১৫,০০০ কোটি টাকা, হল-মার্কের ৪,৫০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৪,৫০০ কোটি টাকা, বিসমিল্লাহওয়ালাদের ১,১০০ কোটি টাকা, ডেসটিনির ৪,১১৯ কোটি টাকা এবংএগুলোর বাইরে হাজার হাজার ছোট ও মাঝারি আত্মসাৎকারী যে কী পরিমাণ টাকা লোপাট করেছে, তার হিসাব কোথাও নেই। এসব অর্থ চুরির সঙ্গে সরকারের প্রিয়পাত্ররাই যে জড়িত থাকবেন, তা যেকোনো বালক-বালিকাও জানে। এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা চুরির সঙ্গে বিদেশি বন্ধুরা জড়িত তা ধরা পড়েছে, কিন্তু জানা গেছে তাদের সঙ্গে বন্ধুতা আছে থানার কর্তাদের কারও কারও। সুতরাং ওই সব ঘটনার জন্যও প্রয়োজন হবে ধামার। টাকা যদি চুরি হয়, তা পাওয়া গেলে ভালো, না পাওয়া গেলে কী আর করা। কিন্তু রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য যদি চুরি হয়, সে ক্ষতি কোনো কিছুর বিনিময়েই পূরণ হয় না। শুধু ব্যাংক নয়, আরও আরও কত প্রতিষ্ঠানের কত অতি গোপনীয় তথ্য বিদেশি বন্ধুদের নোটবইতে টোকা আছে, তার খবর ফেরেশতারা ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ আজ উন্মুক্ত। আমরা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি, তাই আমাদের সবকিছু সবাই জানুক, তাতেই আমাদের সুখ।
দায় সরকারকে নিতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের যে আমলাশ্রেণি, তারা থাকে নিরাপদে। তাদের সহযোগিতা অথবা কর্তব্যে অবহেলা ছাড়া চুরি হোক, জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ হোক, গোপনীয় তথ্য পাচার হোক—কিছুই সম্ভব নয়। কর্মকর্তারা স্বেচ্ছাশ্রম দেন না। তাঁদের বেতন-ভাতার প্রতিটি পয়সা জনগণ দেয়। সেই জনগণের নিমক খেয়ে জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা খুব বড় রকমের অপরাধ। তেমন ক্রিমিনাল প্রজাতন্ত্রে অগণিত। অথচ আজ কতজন বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তা নাজিমউদ্দিন রোড ও কাশিমপুরের ভাত খাচ্ছেন, তা আমাদের জানা নেই। যাঁরা অযোগ্যতা ও অসততাবশত জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে যেকোনো ধরনের চুরি, তা অর্থ হোক তথ্য হোক, রোধ করা সম্ভব হবে না। সবকিছু ধামা দিয়ে চাপা দেওয়াও সম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.