পাকিস্তানের সঙ্গে তিক্ততা বাড়ছেই by রাহীদ এজাজ

ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলম।
গতকাল তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ছে। গত নভেম্বরে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসিকে ঘিরে পাকিস্তান অযাচিতভাবে নাক গলানোয় দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত করে তোলে। আর গত সোমবার দুই দেশের হাইকমিশনের কর্মীদের আটক করার ঘটনায় তা আরও প্রকট হয়েছে।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আপাতত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করার কথা বললেও ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগ দেওয়া এখনো নিশ্চিত নয়। এমনকি ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের প্রস্তাবিত বৈঠক নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল মঙ্গলবার সংসদে এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূল্যায়ন করি এবং পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হবে। ভবিষ্যৎই বলে দেবে সম্পর্ক কোন দিকে যাবে।’
সরকারের জ্যেষ্ঠ এক নীতিনির্ধারক গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখনই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে না চাইলেও সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান যা করছে, তাতে সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে সম্পর্ক কোন পথে যাবে, সেটা বলা মুশকিল।
২০০৯-এ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল, তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে জাল মুদ্রা পাচার ও জঙ্গি অর্থায়নে পাকিস্তানের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর সম্পর্কে দূরত্ব আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দেওয়া সে দেশের রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি সম্পর্ককে আরও খারাপ করেছে। এর জেরে দুই দেশের কূটনীতিক প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ও জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী।
সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর গত ২২ নভেম্বর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি দুই দেশের সম্পর্কের তিক্ততায় নতুন মাত্রা যোগ করে। এর প্রতিবাদে ২৩ নভেম্বর সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। এর পাল্টা হিসেবে ৩০ নভেম্বর ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমি রহমানকে তলব করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবার জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর ইসলামাবাদে ফেরত নেওয়া হয় ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদকে। এর পাল্টা হিসেবে পাকিস্তান গত ৫ জানুয়ারি ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সেলর মৌসুমি রহমানকে ফিরিয়ে নিতে বলে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬ জানুয়ারি মৌসুমি রহমানকে পর্তুগালে বদলি করে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সমশের মবিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন সেটা থামছেই না, বরং পাল্টাপাল্টি পর্যায়ে চলে গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর একাত্তরের নৃশংস ঘটনা অস্বীকার থেকে সম্পর্কের যে টানাপোড়েনের শুরু, তা রীতিমতো সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সে দেশের রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে তাদের বৈরী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। কাজেই সম্পর্কোন্নয়নের জন্য পাকিস্তানকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে পাল্টাপাল্টি চলতেই থাকবে।
তলব করে যা বলা হলো: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম তাঁর দপ্তরে সুজা আলমকে তলব করে ঢাকায় আবরার আহমেদ খানের সন্দেহজনক গতিবিধি এবং ইসলামাবাদে জাহাঙ্গীর হোসেনের নিখোঁজের ঘটনায় বাংলাদেশের অসন্তোষ জানান। সম্প্রতি গুলশানের-২-এ একটি বিশেষ এলাকায় সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে গত সোমবার গোয়েন্দারা পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের কর্মী আবরারকে আটক করেন। এ সময় তাঁর কাছে পরিচয়পত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি। কূটনৈতিক মিশনের কর্মী হয়েও মোটরসাইকেলে কূটনৈতিক নম্বরপ্লেট কেন নেই, তারও কোনো সদুত্তর গোয়েন্দাদের দিতে পারেননি তিনি। পরে সন্ধ্যায় পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব জামিল আক্তার খানের জিম্মায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, আবরার আহমেদ গোয়েন্দাদের হাতে আটক থাকা অবস্থায় গত সোমবার দুপুরে তাঁকে ছাড়ানোর জন্য ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবের কাছে অনুরোধ করেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলম। এ সময় ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব তাঁকে ইতিবাচক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আবরারকে ছেড়ে দেওয়ার পর ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে গতকাল প্রশ্ন তোলেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব। ওই বিজ্ঞপ্তিতে কিসের ভিত্তিতে তাঁকে আটকের ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার ঘুষ ও ক্রসফায়ারের অভিযোগ তুলছে? অন্যদিকে, আবরারকে ঢাকায় ছেড়ে দেওয়ার পর ইসলামাবাদে সাদাপোশাকের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস শাখার কর্মী জাহাঙ্গীর হোসেনকে আটক করেন। এ সময় জাহাঙ্গীর নিজেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস কাউন্সেলরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জানান, আফগানিস্তান দূতাবাসের এক কর্মী জাহাঙ্গীরের কাছে থাকা ওই পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন। তাই এটি যাচাই করার জন্য তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যেতে হবে। এটা বলে তিন-চারজন লোক তাঁকে গাড়িতে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। কয়েক ঘণ্টা পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় যে সম্পর্কের জন্য সহায়ক হচ্ছে না, সেটি গতকাল সুজা আলমকে বেশ জোরালোভাবে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দেখা করার পর পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসলামাবাদে গতকালের ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি আমাকে জানানো হয়েছে। সেখানে কী ঘটেছে আমরা খুঁজে বের করব। তবে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক কালে দুই দেশের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছে, তা অব্যাহত থাকলে সম্পর্কের জন্য ভালো হবে না। কাজেই পাকিস্তানকে সম্পর্কের স্বার্থে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। দুই দেশ সম্পর্কের স্বার্থে দায়িত্বশীল আচরণ করবে, এটাই কাম্য।
যেসব বৈঠকে পাকিস্তান আসেনি: দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার স্পিকারদের সম্মেলন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিক এবং স্যানিটেশন বিষয়ক দক্ষিণ এশিয়ার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক মন্ত্রী জাহিদ হামিদ যোগ দেননি। অবশ্য ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যথাসময়ে ভিসা না পাওয়ায় গত রোববার ঢাকায় শেষ হওয়া স্পিকার সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি সরদার আইয়াজ সাদিক।
ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত মহাসাগরীয় নেভাল সিম্পোজিয়ামে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ জাকাউল্লাহর যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। শেষ মুহূর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে তিনি সিম্পোজিয়ামে যোগ দেন।

No comments

Powered by Blogger.