অতীতমুখী যাত্রাকে ফেরাতে হবে by ড. আমিনুল ইসলাম

বর্তমানে কোনো কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক-নৃশংস আচরণের খবর শুনে আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না। এর পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ বছর আগে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের আচরণের কথাই মনে পড়ে। যখন মানুষ গুহায় বসবাস করত তখন তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকত। যেহেতু সেই পাশবিক আচরণের পুনরাবৃত্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু মানুষের নৃশংস আচরণের কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি মানুষ কী করে তার মানবিক বোধের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে উন্মুখ হয়, তা খুঁজে বের করতে হবে। লাখ লাখ বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্যের মাধ্যমে মানুষ মহাকাশ জয় করতেও সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের মাধ্যমে মানুষের যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বিস্ময়কর হল, এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধিত হয়নি। এর ফলে কেবল যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তা নয়, পুরো মানব সভ্যতার অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে পড়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানুষের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলেও নৈতিকতার চর্চা, সুন্দরের পক্ষ অবস্থান নেয়ার চেষ্টা- এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি অত্যন্ত হতাশাজনক। ফলে আমরা লক্ষ্য করি, মানুষ সভ্যতার শিক্ষা বিসর্জন দিয়ে এমন সব আচরণ করে যাতে তার অমানবিকতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমরা জানি, শিশুর প্রতি সমাজের সব মানুষের বিশেষ মমত্ববোধ থাকে। কিন্তু বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অনেক শিশু নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মৌলিক-মানবিক মূল্যবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ রকম নৃশংস আচরণ অব্যাহত থাকলে মানুষ হিসেবে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সব অর্জনই নিঃশেষ হয়ে যাবে। মানব জাতির শান্তি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে উল্লিখিত অবস্থার উত্তরণে সবাইকে সমন্বিতভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমানে মানুষের মূল্যবোধের যে অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে, এ থেকে পরিত্রাণের জন্য অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা যদি নিজেদের অর্জনকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই, আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের ‘মানুষ’ পরিচয়কে তুলে ধরতে চাই, তাহলে সত্য, সুন্দর, নান্দনিকতা- এসবের পক্ষে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।
কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সভ্যতার খণ্ডিত অগ্রগতিই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। মননশীলতা, মানবিকতা- এসব ক্ষেত্রে মানুষের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি ব্যাহত হলে পুরো মানব সভ্যতাই হুমকির মুখে পড়বে। মানব সভ্যতার আদিম যুগের দিকে যাত্রার বিষয়টি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। আমাদের সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাই সভ্যতার অতীতমুখী যাত্রাকে ফেরাতে পারে।
ড. আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.