সড়ক দুর্ঘটনায় রাজধানীতে পথচারীদের মৃত্যুই বেশি by প্রীতি রাহা

মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে মায়ের কোল খালি করে না ফেরার দেশে চলে গেছে দুই সন্তান। ১৬ জানুয়ারি রাজধানীতে দুটি পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় এই দুই স্কুলছাত্রী প্রাণ হারান। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজধানীতে যে পরিমাণ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন, তাদের বেশির ভাগই পথচারী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা মতে, ঢাকায় বছরে ৪০০ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, যার মধ্যে ৮৫ ভাগ দুর্ঘটনার শিকার হন পথচারীরা। এর মধ্যে ২৬ ভাগ পথচারী রাস্তা পারাপারের সময় দুর্ঘটনার শিকার হন। অপরদিকে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন ৫০ ভাগ পথচারী। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে চালকের জেব্রা ক্রসিং সম্পর্কে ধারণার অভাবকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে অনেক ক্ষেত্রে পথচারীরা সময় বাঁচানোর জন্য ফুটপাত, ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার না করে এবং ট্রাফিক সিগন্যাল না মেনে রাস্তার মাঝ দিয়ে হঠাৎ দৌড় দেয়, যা দুর্ঘটনা ঘটায়। পথচারীদের একটু অসাবধানতা তার জীবননাশের কারণ হতে পারে।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুসারে, রাজধানীতে বর্তমানে দুই সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ৮৩টি ফুটওভার ব্রিজ আছে। এর মধ্যে ৪৩টি উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এবং ৪০টি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। অপরদিকে রাজধানীতে আন্ডারপাস রয়েছে মোট তিনটি, যার দুটি ব্যবহারের অনুপযোগী। ফলে যে উদ্দেশ্যে এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল, তা মূলত কোনো কাজেই আসছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে সারা দেশে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ দুর্ঘটনায় নিহত হন ৮ হাজার ৬৪২ জন, আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। অপরদিকে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ২ হাজার ৬২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৫ হাজার মানুষ। সংগঠনটির মতে, ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে নিহতের সংখ্যা দেড় হাজার কমেছে। গত বছর ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হন, যার সংখ্যা ৩৫৯। এর মধ্যে রাজধানীতেই নিহত হন ২২৭ জন। অপরদিকে, সবচেয়ে কম নিহত হয়েছে কুষ্টিয়া জেলায়, ২৮ জন।
দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউট ঢাকা নগরীর ৫১টি পয়েন্টকে দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০০৯ সালে একটি তালিকা পাঠায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় সাত বছরের বেশি সময়। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এসব পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, মতিঝিল, মৎস্যভবন, সোনারগাঁও, বিজয় সরণি, শনির আখড়া, জসিমউদ্দীন রোড ক্রসিং, শাহবাগ, সায়েদাবাদ ও জিপিও মোড়। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ঢাকায় দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ ফিটনেসহীন যানবাহন ও প্রশিক্ষণহীন গাড়িচালক।
একটি মৃত্যু আর একটি পরিবারের খণ্ডিত হয়ে যাওয়া আমাদের দেশের এখন প্রতিদিনের ঘটনা। সাধারণ মানুষ এসব দেখতে দেখতে পাষাণ হয়ে গেছে। তবুও এখনও এমন অনেকে আছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যাদের হৃদয় কেঁদে ওঠে। যারা পথে চলাফেরা করছেন, তাদেরও একটু সচেতন হতে অনুরোধ করছি। রাস্তা পারাপারের আগে ডানে-বাঁয়ে দেখে নিন। ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতন হোন এবং মেনে চলুন। রাস্তায় চলাফেরার সময় কানে হেডফোন ব্যবহার করবেন না। বাস্তবতা থেকে দেখা যায়, দায়ী চালকের অপরাধের তেমন কোনো সাজা হয় না, কিন্তু যার প্রাণটা যায়, তা আর ফিরে আসে না। সময় বাঁচানো কিংবা কষ্ট লাঘবের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নেবেন না। মনে রাখবেন, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
preetiraha@ymail.com

No comments

Powered by Blogger.