রাজনৈতিক দল ভাঙাভাঙির ইতিবৃত্ত by সৈয়দ আবুল মকসুদ

এই জগৎ-সংসারে ভাঙার মতো জিনিস এত রয়েছে যে তা বলে শেষ করা যায় না। চিরকাল কোনো কিছুই অটুট থাকে না। বৃক্ষেরও ডাল ভাঙে। নদীর তীর ভাঙে। স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভাঙে। মানুষের এবং কোনো কোনো জাতির কপাল ভাঙে। রাজনৈতিক দলই-বা ভাঙবে না কেন? তেলের শিশি ভাঙলে আমরা খুকির ওপর রাগ করি, অথচ ধেড়েরা যখন দল ভাঙাভাঙি করে, তখন আমরা উপভোগ করি।
রাজনৈতিক দল তেলের শিশি নয়, স্বামী-স্ত্রীর সংসারও নয়, তবু কেন ভাঙে? কারা ভাঙেন? ভাঙায় কার লাভ, কার ক্ষতি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে অতীতে।
গত ১০০ বছরে ভাঙেনি কোন দল? ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙেছে। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ভেঙেছে। কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙেছে। আওয়ামী লীগ ভেঙেছে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ভেঙেছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ভেঙেছে। ইসলামী ঐক্যজোট ভেঙেছে। সাম্যবাদী দলও ভেঙেছে। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আগেই সর্বহারা পার্টিও ভেঙেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যে কতবার ভেঙেছে, তা তাদের নেতাদের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। ‘আসল বিএনপি’ বলে কোথাও কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে নকল বিএনপির নেতাদের সম্ভবত কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু কয়েক দিন আগে ‘আসল’ ও নকলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুচারু ব্যবস্থাপনায় নয়াপল্টনে যে যুদ্ধ হয়ে গেল, অতীতে গ্রিক ও রোমানদের মধ্যেও ওই রকম সংঘর্ষ হয়েছে কি না সন্দেহ। আসলের পদাঘাতে নকলের ঊরুর হাড় পর্যন্ত স্থানচ্যুত হয়েছে। এসব যে দল ভাঙাভাঙি নাটকের পূর্ব রাগ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সরকারি দলের মুখপাত্ররা বলছেন, বিএনপি ভেঙে চিনামাটি ও মেলামিনের বাসন-পেয়ালার মতো ‘খান খান’ হয়ে যাবে। জোটের আরেক দলের নেতা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে কোনো মিটমাট হবে না, বিএনপিকে ধ্বংস করতে হবে। একটি জিনিস তাঁরা খেয়াল করছেন না যে নেতাদের ধ্বংস করা যায়, সমর্থকদের ধ্বংস করা সম্ভব নয়। ওদিকে উত্তাল সমুদ্রে দিগ্ভ্রান্ত সাম্পানের মতো টালমাটাল বিএনপির মুখপাত্ররা হাহাকার করছেন এই বলে যে তাঁদের দল ভাঙার জন্য সরকার হাতুড়ি-শাবল ঠুকছে। গোপনে গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই যে দল ভাঙাভাঙির একটা মহড়া চলছে, তাতে কারোরই সন্দেহের সামান্যতম অবকাশ নেই। এ বছরের শেষ বা আগামী বছরের প্রথম দিকে একটা নির্বাচন করতে চাইলে দল ভাঙাভাঙির বিলকুল প্রয়োজন রয়েছে।
রাজনৈতিক দল ভাঙার সঙ্গে নদীভাঙনের মিল রয়েছে। কবির ভাষায়—নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। এক দল ভেঙে যদি দুর্বল হয়, আরেক দলের শক্তি বাড়ে। সাধারণত নৈতিকভাবে দুর্বল কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই প্রতিপক্ষ বিরোধী দলে ভাঙন ধরিয়ে আনন্দ পায়। এই দল ভাঙাভাঙির খেলা বাংলার মানুষ দেখেছে পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে। ক্ষমতার লোভে যাঁরা দল ভাঙেন বা দল ছাড়েন, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে তাঁদের ঠাঁই হয় এবং দল ভাঙার প্ররোচনাকারীদের স্থান হয় ইতিহাসের নিন্দনীয়দের সঙ্গে।
গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে মধ্য ৫০-এ দল ভাঙাভাঙির লীলাখেলা শুরু হয়। প্রথমবার বিরোধী দলে গিয়ে মুসলিম লীগেও ভাঙন দেখা দেয়। ১৯৫৫ সালে প্রাদেশিক লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের আগে সভাপতি নূরুল আমিন, সহসভাপতি নবাব হাবিবুল্লাহ, যুগ্ম সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান, প্রচার সম্পাদক খান এ সবুরসহ কয়েকজন পদত্যাগ করলে ভাঙন প্রকাশ্য রূপ নেয়।
যুক্তফ্রন্টের দলাদলিতে এবং ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগেও ভাঙন দেখা দেয়। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সরকারের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেন। তাতে নেতৃত্ব দেন আবদুস সালাম খান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, খালেক নেওয়াজ খান, হাশিম উদ্দিন প্রমুখ। দলের মূলধারায় ছিলেন মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, এমনকি যুবনেতা তাজউদ্দীন আহমদ। ভাঙনপন্থী সালাম খানদের স্থান আদৌ ইতিহাসের কোথাও হয়েছে কি না, তা জানারও প্রয়োজন মনে করে না মানুষ।
আদর্শের কারণে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে যদি কেউ আলাদা সংগঠন গঠন করেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। সে রকম ঘটনা এ দেশের ইতিহাসে একবারই ঘটেছিল, ১৯৫৭-তে। যখন নিজেদের দল প্রদেশে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতায়, চিফ মিনিস্টার ও প্রাইম মিনিস্টার নিজের দলের, তখনই আদর্শগত কারণে একটি পক্ষ দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য কয়েকটি বাম দলকে নিয়ে গঠন করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
আওয়ামী লীগে আর একবার সরকার ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে মধ্য ৬০-এর দিকে। তখন আইয়ুবের একনায়কী শাসনকাল। তাঁর লোক মোনায়েম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। আওয়ামী লীগ ছিল তাঁর দুই চক্ষের শূল। ১৯৬৪-তে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। দলের অবস্থা তখন এখনকার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের দলের চেয়েও শোচনীয়। আওয়ামী লীগকে আরও দুর্বল করার জন্য এবং শেখ মুজিবকে নেতৃত্ব থেকে দূর করতে গভর্নর মোনায়েম নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নেন। দলকে ভাঙতে কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে তিনি আলাদা আলাদাভাবে গভর্নর হাউসে চা খেতে আমন্ত্রণও জানান। অন্য দলের নেতাদের সঙ্গেও রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেন। মোদ্দা কথা, সংসদীয় গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তা মুজিবকে মাইনাস করার জন্য নামীদামি নেতাদের হাত করে ফেলে সরকার। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে মুজিব-সমর্থকেরা ঘরোয়া সভা করার জন্য হলঘর ভাড়া পর্যন্ত পেতেন না ঢাকার কোথাও। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেই অনেক সভা করতে হতো। এখনকার মতো এত বড় বড় বস্তাভর্তি টাকা তখন ছিল না। তবে মোনায়েমের থলেভর্তি টাকা অনেকেই পেয়েছেন মুজিবকে বিরোধিতা করার জন্য এবং সে টাকায় তাঁরা ধানমন্ডি-গুলশানে আম-কাঁঠালের বাগানসহ বড় বড় বাড়ি বানাতে পেরেছেন।
ছয় দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের ভাঙন আর রোধ করা গেল না। যে কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা অনুমোদন করা হবে, তার দুই-তিন দিন আগেই দলের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশসহ কয়েকজন নাটকীয়ভাবে দল থেকে সটকে পড়েন। সেই সব নাটকীয় মুহূর্তের কথা দলের বাইরের লোক আমাদের যখন মনে আছে, বর্তমান আওয়ামী লীগের অনেক নেতারও মনে থাকার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে হোটেল ইডেনের প্রাঙ্গণে হয়েছিল কাউন্সিল অধিবেশন। সভাপতির পদটি খালি হচ্ছে এই সুখবরে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ছয় দফাবিরোধী আবদুস সালাম খান। এখনকার পাঠকদের শুনতেই চোখ কপালে উঠবে, তা হলো ওই সম্মেলনে শাহ আজিজুর রহমানও যোগ দেন। আগ বাড়িয়ে কেউ এলে তাকে তাড়িয়েও দেওয়া যায় না।
ওই অধিবেশনটি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে যাঁরা দলের নেতা নির্বাচিত হন তাঁরা হলেন: সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান, সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুস সালাম খান, খোন্দকার মোশতাক, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ; সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক আমেনা বেগম প্রমুখ। দল ভাঙে। তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খানরা আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। কিছুদিন পর সালাম খান, শাহ আজিজও স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
রাষ্ট্রীয় জীবনে যত রকম নিকৃষ্ট কাজ আছে, তার মধ্যে দল ভাঙাভাঙি ও ক্ষমতার লোভে দলত্যাগ সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ও নোংরা কাজ। যখন রাজনীতিকদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল থাকে, তখনই এসব হয়ে থাকে। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের মধ্যেই এ-জাতীয় ব্যাপার বেশি ঘটে। ব্যক্তিস্বার্থে এ রকম দলত্যাগীদের একবার আমার এই কলামে নাম দিয়েছিলাম মোতাজিলাপন্থী রাজনীতিক।
আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী ও নেলসন ম্যান্ডেলা যা করতে পারেননি, বিএনপির এক মোতাজিলাপন্থী ব্যারিস্টার তা করে দেখিয়েছেন। গত তিন বছরে তিনি তিন-তিনটি দল ও জোট গঠন করেছেন। আমাদের কোনো কোনো মিডিয়া চুটিয়ে এই জনপ্রিয় বঙ্গনেতাকে প্রচার দেয়। জনগণ বুঝতে পারে না তাঁর কাছে রাজনীতি বড়, না স্ত্রীকে রেলের ইজারা দেওয়া জমি রক্ষা বড়। কয়েক দিন আগে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর দল গঠিত হবে একেবারে তৃণমূল থেকে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রাধান্য না পেয়েই পারে না। ১০ বছর বিএনপির মন্ত্রী থাকাকালে তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে শাহরিয়ার কবিরকে বিচিত্রা থেকে বিতাড়িত করেন এবং জাহানারা ইমামসহ বহু দেশপ্রেমিকের ললাটে এঁটে দেন দেশদ্রোহীর তকমা।
বহু দুঃখের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত যে দেশ, তাকে সবাই মিলেমিশে গড়ে তোলাই রাজনীতিকদের ব্রত হওয়া কাম্য। কোনো রকম ষড়যন্ত্র, তামাশা, নোংরামো পরিত্যাজ্য। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, মাটি কামড়ে যাঁরা দলে পড়ে থাকেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরাই লাভবান হন।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত তার নিজের চরকায় তেল দেওয়া। অন্য দলের ক্ষতি করার চেয়ে নিজ দলের কী করে জনপ্রিয়তা বাড়বে, সে চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কয়েক দিন যাবৎ পত্রপত্রিকায় দেখছি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিলম্বিত জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে মাস দু-তিনের মধ্যে। যেকোনো দলের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অপেক্ষাকৃত সৎ ও নিবেদিত নেতাদের নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠিত হবে, এই প্রত্যাশা করি। কারণ, একটি আদর্শভিত্তিক ভালো দলই ভালো রাজনীতি দিতে পারে। ভালো রাজনীতিই সমৃদ্ধ জাতি গঠনের যোগ্যতা রাখে। দল ভাঙাভাঙিতে অর্থ ও শক্তি ক্ষয় করে দেশের কোনো লাভ হবে না। আমরা চাই, সুশৃঙ্খল জনকল্যাণকামী রাজনৈতিক দল।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক৷

No comments

Powered by Blogger.