বর্ণনাতীত নৃশংসতা : সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রসঙ্গে নোয়াম চমস্কি

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এখন সর্বোচ্চ শক্তিতে বৈশ্বিক যুদ্ধাভিযানে পরিণত হয়েছে। অথচ আইএসআইসের মতো ভয়ঙ্কর সংগঠনগুলোর উত্থান ও বিকাশের আসল কারণ পুরোপুরিই অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। নভেম্বরে প্যারিস হত্যাযজ্ঞের পর ফ্রান্স ও জার্মানির মতো প্রধান প্রধান পাশ্চাত্য দেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দিয়েছে। একই ধরনের ভয়ে ভীত হয়ে রাশিয়াও তাড়াহুড়া করে এই ক্লাবে যোগ দিয়েছে। বস্তুত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়া তার নিজস্ব ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইএসআইএসকে সমর্থন জুগিয়ে যাবার অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘনের কথিত ঘটনায় তুরস্ক রুশ বিমানগুলো ভূপাতিত করার পরই রাশিয়া ‘সন্ত্রাসীদের মদদদাতা’ হিসেবে তুরস্ককে অভিযুক্ত করছে।
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ কোনো অর্থ আছে কি? এর কী কোনো কার্যকর নীতি আছে? আর রোনাল্ড রিগ্যান ও জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের আমলের আগের দু’টি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ পর্যায় থেকে বর্তমানটির পার্থক্য কোথায়? অধিকন্তু ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ থেকে আসলে কে লাভবান হচ্ছে? এবং মার্কিন সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স ও যুদ্ধ সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্কটা কী? মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিশ্বখ্যাত সমালোচক নোয়াম চমেস্কি এসব ইস্যু নিয়ে ট্রুথআউটকে তার উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন। বিশেষ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সি জে পলিক্রুনিউ। এর অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাসান শরীফ
প্রশ্ন: প্রথমেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আপনার ধারণা শুনতে চাইব। এই নীতিটা সেই রিগ্যানের আমলে শুরু হয়েছিল, যা এর পরই জর্জ ডব্লিউ বুশ (ইসলামাতঙ্ক) ‘ক্রুসেড’-এ পরিণত করেছিলেন, যেটা স্রেফ অপরিমেয় সংখ্যক নিরীহ মানুষের জীবন নিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বশান্তির ওপর প্রবল প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার কিছু মিত্রের চেয়ে ভিন্ন ধরনের পলিসি এজেন্ডা এবং স্বার্থ নিয়ে অন্য আরো কয়েকটি দেশ এতে লাফিয়ে সামিল হওয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নতুন এবং সম্ভবত আরো বিপজ্জনক ধাপে প্রবেশ করছে। প্রথমত, আপনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পর্কে ওপরে বলা মূল্যায়নের সাথে একমত হলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্থায়ী বৈশ্বিক যুদ্ধের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিণতি, বিশেষ করে পাশ্চাত্য সমাজের জন্য, কী হতে পারে?
চমস্কি : একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিলে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ পর্যায় দু’টি পরস্পর থেকে বেশ ভিন্ন। রিগ্যানের যুদ্ধ খুবই দ্রুত খুনে সন্ত্রাসী যুদ্ধে পরিণত হয়, সম্ভবত ওই কারণেই এটা ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেছে। তার সন্ত্রাসী যুদ্ধ মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি নিয়ে আসে। সবচেয়ে প্রত্যক্ষ টার্গেট ছিল মধ্য আমেরিকা। তারা এখনো সেই ক্ষত সারিয়ে উঠতে পারেনি। বর্তমান উদ্বাস্তু সঙ্কটের প্রধান কারণগুলোর একটি হলো এটা (খুব কমই এর উল্লেখ হয়)। দ্বিতীয় পর্যায়টির (যেটি জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০ বছর পর ২০০১ সালে আবার ঘোষণা করেছিলেন) ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রত্যক্ষ আগ্রাসন বিশাল এলাকা ধ্বংস করে দেয়, সন্ত্রাস নতুন আকার ধারণ করে, বিশেষ করে ওবামার বৈশ্বিক গুপ্ত হত্যার (ড্রোন দিয়ে) অভিযানে সন্ত্রাসবাদের বিবরণীতে নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং এ ধরনের ব্যবস্থায় সন্দেহভাজনদের যতজনকে হত্যা করা হয়, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার চেয়ে বেশি নিবেদিতপ্রাণ সন্ত্রাসীর সৃষ্টি করে।
বিশ্ব জনমত যুক্তরাষ্ট্রকে শান্তির জন্য বিপুলভাবে বৃহত্তম হুমকি মনে করে। বুশের যুদ্ধ টার্গেট ছিল আলকায়েদা। একটার পর একটা ভয়াবহ আঘাত হেনে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং তারপর আরো অনেক) জিহাদি সন্ত্রাসকে আফগানিস্তানের ছোট্ট উপজাতীয় এলাকা থেকে লেভ্যান্ট (সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান ও ইসরাইল নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ এলাকা) হয়ে পশ্চিম আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। ইতিহাসের অন্যতম পরিচালনা দক্ষতাগত সাফল্য। এর মধ্যে আবার আলকায়েদার স্থানে আবির্র্ভূত হয় আরো বেশি খারাপ ও ভয়ঙ্কর অনেক উপাদানের। বর্তমানে আইএসআইএস (আইএসআইএল, ইসলামিক স্টেট) দানবীয় নৃশংসতার রেকর্ডের অধিকারী। তবে শিরোপাটির অন্য দাবিদাররা খুব বেশি পেছনে নেই। কয়েক বছর পেছনে থাকা এই গতিশীলতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন সামরিক বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু কুকবার্ন তার গ্রন্থ ‘কিল চেইন’-এ। তিনি প্রামাণ্যভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, মূল ও কারণগুলো সমাধান না করে দৃশ্যগ্রাহ্য কোনো নেতাকে হত্যা করা হলে নিশ্চিতভাবেই খুব দ্রুত তার স্থলাভিষিক্ত হয় আরো তরুণ, আরো যোগ্য এবং আরো বেশি ভয়ঙ্কর কেউ।
এসব অর্জনের একটি পরিণাম হলো বিশ্ব জনমত বিপুল ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রকে শান্তির জন্য বৃহত্তম হুমকি মনে করে। অনেক পেছনে থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের এত ওপরে থাকার কারণ দৃশ্যত বিপুল ভারতীয় ভোট। যে সাফল্য ইতোমধ্যেই দেখা গেছে, তা আরো বাড়লে জ্বলতে থাকা মুসলিম বিশ্বের সাথে বৃহত্তর যুদ্ধও সৃষ্টি করতে পারে, অন্য দিকে পাশ্চাত্য সমাজগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ দমন এবং নাগরিক অধিকার খর্ব এবং বিপুল ব্যয়ের বোঝায় নতজানু দেখতে পাবে, যা আসলে ওসামা বিন লাদেনের সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন (এবং বর্তমানের আইএসআইএসের) বাস্তবায়ন।
প্রশ্ন: মার্কিন নীতি প্রণয়ন আলোচনা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে কেন্দ্র করেই ঘোরাফেরা করছে, প্রকাশ্য ও গোপন কার্যক্রমের মধ্যকার পার্থক্য পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এ দিকে সন্ত্রাসী গ্র“পগুলোর শনাক্তকরণ এবং সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনকারী কর্তা বা রাষ্ট্রগুলো নির্বাচন করা দৃশ্যত কেবল পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারমূলকভাবেই হচ্ছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্তকরণ এই প্রশ্নও সৃষ্টি করছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সত্যিই কি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নাকি বিশ্বজয়ের নীতিমালাকে যৌক্তিক করতে এটা স্রেফ ধাপ্পাবাজির আবরণ? এ ব্যাপারে আপনার কোনো মন্তব্য আছে কি?
চমেস্কি : রিগ্যান ও বুশের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সংস্করণ নিয়েও একই সত্য প্রযোজ্য। রিগ্যানের কাছে এটা ছিল মধ্য আমেরিকায় হস্তক্ষেপের অজুহাত। সালভাদোরের বিশপ রিভার ওয়াই দাদাস (তিনি গুপ্তহত্যার শিকার আর্চবিশপ অস্কার রোমেরোর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন) বিষয়টাকে বর্ণনা করেছেন ‘অসহায় বেসামরিক লোকজনকে সম্পূর্ণ বিলীন করা এবং তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা চালানোর যুদ্ধ’ হিসেবে।
গুয়াতেমালার পরিস্থিতি ছিল আরো খারাপ, হন্ডুরাসে ছিল ভয়াবহ। নিকারাগুয়া ছিল একটি দেশ, যার রিগ্যানের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার একটি সেনাবাহিনী ছিল; অন্য দেশগুলোর নিরাপত্তা বাহিনীই ছিল সন্ত্রাসী।
আফ্রিকার দক্ষিণাংশে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ দেশে ও বিদেশে ভয়ঙ্কর মাত্রায় করা দক্ষিণ আফ্রিকান অপরাধের অজুহাত তুলে দেয়। সর্বোপরি আমাদেরকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে জঘন্য সন্ত্রাসী গ্র“পের একটি’ নেলসন ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কাছ থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করতে হয়েছিল। ম্যান্ডেলা নিজে পর্যন্ত ২০০৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন সন্ত্রাসী তালিকায় ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ লেবানন এবং অন্যান্য স্থানে ইসরাইলি খুনে আগ্রাসনের সমর্থন সৃষ্টি করে। আর বুশের জন্য এটা ইরাক আক্রমণের অজুহাতের ব্যবস্থা করে। এভাবেই এটা এখনো চলছে।
সিরিয়ার নৃশংসতার কাহিনী ভাষাতেও প্রকাশ করা যায় না। আইএসআইসের বিরোধিতাকারী প্রধান স্থলবাহিনী দৃশ্যত কুর্দিরা, ইরাকের মতো এখানেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় রয়েছে। উভয় দেশেই তারা আমাদের ন্যাটো মিত্র তুর্কিদের হামলার প্রধান টার্গেট। এই দেশটি সিরিয়ায় আলকায়েদার সহযোগী সংগঠন আলনুসরা ফ্রন্টকেও সমর্থন দিচ্ছে। আইএসআইএস আর আলনুসরার মধ্যে পার্থক্য আছে খুব সামান্যই, যদিও তারা খুবই কঠিন যুদ্ধে রয়েছে।
আলনুসরা এবং এর ঘনিষ্ঠ মিত্র আহরার আলশ্যামকেও মার্কিন মিত্র সৌদি আরব ও কাতার সমর্থন করছে এবং মনে হচ্ছে, সিআইএ’র কাছ থেকে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার পাচ্ছে। এমন খবরও পাওয়া গেছে, তারা আসাদ সেনাবাহিনীকে মারাত্মক পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিতে সিআইএর সরবরাহ করা টিওডব্লিউ ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করছে। সম্ভবত এটাই রাশিয়াকে হস্তক্ষেপ করতে উদ্দীপ্ত করেছে।
সিরিয়ায় একমাত্র ক্ষীণ আশার রেখা হতে পারে আইএসআইএসকে বাদ দিয়ে সম্পৃক্ত বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে আলোচনা। তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারেন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের মতো সত্যিই আতঙ্কিত লোকজন, যারা আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক না হওয়ায় আলোচনায় সম্পৃক্ত হতে চাইবেন, যদি না জাতীয় আত্মহত্যার সর্পিলগতি অব্যাহত থাকা বন্ধ করতে হয়। আর পরিশেষে এই পথের গন্তব্য হবে ভিয়েনা। বাস্তবভাবে আরো কিছু করতে হবে। তবে কূটনীতিতে পরিবর্তন অনিবার্য।

No comments

Powered by Blogger.