আইনভিত্তিক এশীয় ব্যবস্থার মডেল by স্কট এইচ সুইফট

২০১৬ সালের শুরুতে ঢাকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী আয়োজিত ভারত মহাসাগরীয় নৌ-সিম্পোজিয়াম (আইওএনএস) উপলক্ষে এ অঞ্চল সফরের মধ্য দিয়ে এই বছর কেমন হবে, তা আগেই অনুমেয়। আইওএনএসে আঞ্চলিক নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সহযোগিতা গভীর করতে, আমাদের স্বার্থের মিল রয়েছে তা তুলে ধরতে এবং অমিলের জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে। বাংলাদেশে আমার অনেক সফরের মধ্যে এই সফরটিও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধির গুরুত্ব বহন করে।
এই সম্পর্ক সাগরের সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার ব্যাপারে আমাদের সবার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটায়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের একসময়ের হ্যামিল্টন-ক্লাস কাটার বিএনএস সমুদ্র জয় ও বিএনএস সমুদ্র অভিযান বঙ্গোপসাগরে এবং এর বাইরে পরিচালনা করছে। আমাদের বার্ষিক নৌ-অনুশীলন ‘কো-অপারেশন অ্যাফ্লোট রেডিনেস অ্যান্ড ট্রেইনিং’ (ক্যারাট) বাংলাদেশ গত অক্টোবরে চট্টগ্রামের সমুদ্রতীরে শেষ হয়েছে। ক্যারাট চলাকালে আমাদের দুই নৌবাহিনী জলদস্যুবিরোধী, চোরাচালানবিরোধী, সমুদ্রে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং বন্দর নিরাপত্তা বিষয়ে অনুশীলন করে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে, বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রথম দক্ষিণ এশীয় নৌবাহিনী হিসেবে সিঙ্গাপুরে ‘সাউথইস্ট এশিয়া কো-অপারেশন অ্যান্ড ট্রেইনিং’য়ে (সিক্যাট) পরিদর্শক হিসেবে অংশ নেয় এবং আমরা ভবিষ্যতে আরও অনুশীলনে অংশ নিতে তাদের স্বাগত জানাই।
কেউ ভাবতে পারেন, ‘ইউএস প্যাসিফিক ফ্লিট’ নাম থেকে যে আমরা শুধু মালাক্কা প্রণালির পূর্ব ও সিঙ্গাপুরের ওপর গুরুত্ব দিই; এর চেয়ে সত্যের অপলাপ আর কিছুই হতে পারে না। প্রণালির পূর্ব দিকে তাকালে দেখব সমুদ্রকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ের ফলে অনেক জাতি উপকৃত হয়েছে—এমন আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। যা হোক, পশ্চিমের দিকে তাকালে আমি দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আঞ্চলিক নৌবাহিনীগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা দেখতে পাই।
তিনটি দেশই এ অঞ্চলে নেতৃত্বসুলভ মনোভাব দেখিয়েছে এ প্রক্রিয়ায় একমত হয়ে ও বিচার মেনে নিয়ে। আমি আশাবাদী যে অন্য এশীয় দেশগুলো দীর্ঘদিনের সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য এ উদাহরণ কাজে লাগাবে
প্রণালির উভয় পাশেই সামুদ্রিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মূলে রয়েছে প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা। বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ বার্ষিক প্রায় ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার শুধু দক্ষিণ-চীন সমুদ্র দিয়েই পরিচালিত হয়। প্রায় এক লাখ জাহাজ এই পণ্য সরবরাহ করে ভারত মহাসাগর থেকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথ ধরে, যা শত শত বছর আগে যখন পালতোলা জাহাজ মৌসুমি বায়ুর গতিপথ কাজে লাগিয়ে চলাচল করত। বাণিজ্যের বাইরে, সমুদ্র তলদেশের তেল ও গ্যাস–সম্পদ এবং উপরিভাগের মৎস্যভান্ডার জীবনধারণের এক দীর্ঘস্থায়ী সম্পদের ক্ষেত্র।
একটি নিরাপদ সামুদ্রিক পরিবেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অবাধ চলাচলকে সহায়তা করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আন্তর্জাতিক আইন কাজে লাগিয়ে দুটি দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধান পরিলক্ষিত হয়। ২০১২ সালে, ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সিজ’ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে, যার ফলে দুই দেশই উপকৃত হয়েছে। আরেকটি সংস্থা ‘দ্য পারমানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন’ এর দুই বছর পর পশ্চিমে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে। তিনটি দেশই এ অঞ্চলে নেতৃত্বসুলভ মনোভাব দেখিয়েছে এ প্রক্রিয়ায় একমত হয়ে ও বিচার মেনে নিয়ে। আমি আশাবাদী যে অন্য এশীয় দেশগুলো দীর্ঘদিনের সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য এ উদাহরণ কাজে লাগাবে এবং আন্তর্জাতিক আইনকে স্বীকৃতি দিয়ে ফোরামে একই ধরনের মনোভাব পোষণ করবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে।
যখন জাতিগুলো সমুদ্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও আগ্রাসন রুখতে নৌবাহিনীকে সম্পৃক্ত করে, তখন পুরো অঞ্চল অধিকতর নিরাপদ ও সমৃদ্ধিশালী হয়। সোমালিয়া উপকূলের ও গালফ অব অ্যাডেনের জলদস্যুতা মোকাবিলায় বহুজাতিক টহল একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এক দশকেরও আগে, ২০০৪-এর ভারত মহাসাগরে সুনামির জন্য ত্রাণ তৎপরতা এবং অতিসম্প্রতি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বিমান এমএইচ-৩৭০-এর তল্লাশি আঞ্চলিক নৌবাহিনীর একসঙ্গে কাজ করার একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। এ ধরনের মর্মান্তিক পরিস্থিতি মোকাবিলা কোনো একটি দেশের একক ক্ষমতার বাইরে। এ ধরনের সব চ্যালেঞ্জ যেহেতু বজায় রয়েছে তাই যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী ক্যারাট ও সিক্যাট চলাকালে প্রধান নৌ-দক্ষতাসমূহের অনুশীলন অব্যাহত রাখবে। এটা দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি আবারও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফিরে আসার আশা রাখি এবং এ বছরের শেষের দিকে হাওয়াইয়ে ‘রিম অব দ্য প্যাসিফিক’ অনুশীলন চলাকালে এ অঞ্চলের নৌবাহিনীগুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। আমি এ পর্যন্ত যা দেখেছি, তাতে আমি মনে করি সেই দৃশ্য হবে অভূতপূর্ব।
অ্যাডমিরাল স্কট এইচ সুইফট: ইউএস প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার। (বর্তমানে বাংলাদেশ সফররত)

No comments

Powered by Blogger.