অসংগতি রেখেই নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়ন! by আলী ইমাম মজুমদার

নতুন বেতন স্কেল-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। জেনে ভালো লাগে, সরকারি কর্মচারীরা অধিকতর উচ্চ বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পেতে যাচ্ছেন। এতে রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। তবে কাজের গতিও বাড়ার কথা। ভালোভাবে জীবনধারণের নিশ্চয়তা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্বের প্রতি অখণ্ড মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে। তাই স্বাগত জানাতে হয়।
তবে এটাও জানা যায়, কিছু স্পর্শকাতর বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেল। সেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছাকে ম্লান করে দেয় কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকবে না। এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে প্রবল। চাকরির সূচনা স্তরে ক্যাডার পদের চেয়ে নন-ক্যাডারধারীদের একধাপ নিচে বেতন নির্ধারণের ব্যবস্থা হচ্ছে। নন-ক্যাডার পদে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদসহ অনেক মেধাবী কর্মকর্তা আছেন। এ ধরনের সিদ্ধান্তের আবশ্যকতা ও এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছিল কি না, তা বোধগম্য নয়।
আরেকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে। তা হলো এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়ার পর বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন স্কেল নির্ধারিত হবে। বিষয়টি আসে জাতীয় বেতন কমিশনের প্রতিবেদন থেকে; যাতে প্রস্তাব করা হয়েছে, সব স্কুল-কলেজছাত্র বেতন থেকে প্রাপ্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নতুন স্কেলে বেতন দেওয়া হবে। যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার শতভাগ বেতন দেয়, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয় সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে প্রস্তাবটিকে যৌক্তিকই মনে হবে। কমিশনের এ প্রতিবেদন যৌক্তিক মনে করলে এত দিনেও তা পর্যালোচনা করা হয়নি কেন, তা বোধগম্য নয়। এ বেতন স্কেল কার্যকর করতে অনেক সময় নেওয়া হয়েছে। এরপরও বিষয়টি অমীমাংসিত রাখা যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। উল্লেখ্য, ২০০৫ ও ২০০৯ বেতন স্কেল ঘোষণার সময়ই এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন চূড়ান্ত হয়ে যায়।
এখন হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয় পর্যালোচনা করে এবং আয়ের অর্থ সরকারি কোষাগারে দেওয়ার পথ বের করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করবে। এই কমিটির সুপারিশ কার্যকর হওয়ার পর শিক্ষকেরা নতুন প্রস্তাবিত কাঠামোতে বেতন পাবেন। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘শতভাগ’ বেতন-ভাতা সরকার দেয়, এটা বহুল প্রচলিত একটি কথা। সুতরাং তাঁরা সরকারি কর্মচারীদের মতোই আর্থিক অবস্থানে আছেন—এমনটাও অনেকে ধারণা করেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, সেই বেতন হলো স্কেলের সূচনা স্তরে। আর সারা জীবনে একটি বেতন বৃদ্ধি পান চাকরির আট বছর পূর্তির পর। বাড়িভাড়া, স্কুল-কলেজ আর অধ্যক্ষ থেকে সহকারী শিক্ষক—সবার জন্য মাসে পাঁচ শ টাকা। আর চিকিৎসা ভাতা তিন শ টাকা। শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ আর কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ। অবশ্য বছরে দুবার। এগুলো আগের স্কেলেও সরকারি দপ্তরের সর্বনিম্ন স্তরের একজন কর্মচারীর বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও ক্ষেত্রবিশেষে উৎসব ভাতার চেয়েও কম। জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগরদের আমরা এ অবস্থায় রেখে কীভাবে মানসম্মত শিক্ষার চিন্তা করছি?
কেন জানি এমনটা মনে হচ্ছে, সরকারের ভেতরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে নেই সুস্পষ্ট ধারণা। কিছুদিন আগে হঠাৎ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বেতনের ওপর ভ্যাট চাপল। আবার প্রবল দাবির মুখে তা উঠেও গেল। এসব প্রতিষ্ঠানের দোষত্রুটি নেই, এমন নয়। তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সরকার নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে। আর সে জন্যই তো এমপিওর মাধ্যমে তাদের কিছুটা বেতন-ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
বেসরকারি স্কুল-কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেল দেওয়া যে যুক্তিতে আটকে রাখা হচ্ছে, সেই বাস্তবতা তো আগেও ছিল। এ কারণে আগেরবারের বেতন স্কেল আটকে রাখা হয়েছিল, এমন তো নয়। এবার এটা করতে গিয়ে সরকার অকারণ সমালোচনার সম্মুখীন হবে। উল্লেখ্য, বেসরকারি পর্যায়ে স্কুল ও কলেজের সংখ্যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি। আর মাদ্রাসারও একই অবস্থা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক ও ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার অবকাঠামো নির্মাণ বা সম্প্রসারণে সহায়তা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ছাত্র বেতন থেকে তাদের কিছু আয় হয় বটে। তবে এটা গুটি কয়েক নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্যগুলোকে একই বিবেচনায় নিলে চলবে না। সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র বেতন থেকে আয় যথেষ্ট কম। আর সেই আয় থেকে ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের কিছু টাকাও দেওয়া হয় বাড়িভাড়া ও ভাতা হিসেবে। এটাকে অনৈতিক বলবেন? আর অনেক প্রতিষ্ঠান তাও দিতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত চাহিদার তুলনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা কম। সেখানে স্থানীয় পরিচালনা কমিটি দু-চারজনকে নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের তহবিলের টাকায় বেতনও দেয়। এটাকেও কি অনৈতিক বলবেন?
এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের আসবাব ক্রয় ও মেরামত, কাগজ-কলম, খাতাপত্র, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা করতেও টাকা লাগে। সরকারি স্কুল-কলেজে যেখানে প্রায় বিনা বেতনে পড়ার ব্যবস্থা, সেখানে মফস্বলের বেসরকারি স্কুল-কলেজ, ছাত্র বেতন কতই বা ধরতে পারে? আর অভিভাবকদের সামর্থ্য তো বিবেচনায় নিতে হয়। এটা সত্য, ঢাকা ও এর বাইরের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতি মাত্রায় সচ্ছল। তাদের তো এমপিও দরকারই হওয়ার কথা নয়। অবশ্য কেউ কেউ এটা ছেড়েও দিয়েছে। অবশিষ্টগুলোর অধিকাংশই কিন্তু নাজুক আর্থিক অবস্থায় আছে। ছাত্র বেতন থেকে তেমন কিছু আসে না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। কোথাও খেলার মাঠে বসানো হয় গরুর হাট বা পাইকারি সবজি বাজার। আবার ক্ষেত্রবিশেষে যাত্রাপালার ব্যবস্থা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন মূল্যবান বৃক্ষ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়ে যায়। কোথাও বা প্রতিষ্ঠানের জমির অংশবিশেষে দোকানপাটও করতে দেওয়া হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান খণ্ডকালীন কমিউনিটি সেন্টার হিসেবেও ভাড়া দেওয়া হয়। দূরে যেতে হবে না, খোদ রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিশাল এলাকা নিয়ে থাকা বেসরকারি স্কুলটি গাড়ির হাটসহ অন্য প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়। এটা কোন নিয়মে আর টাকা যায় কোথায়? এই কাজগুলোতে শিক্ষকদের ভূমিকা থাকলেও খুব কম। কমিটি কিংবা স্থানীয় কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি এরূপ করে থাকেন। যাঁরা বাধা দিতে পারেন বা দেখার কথা, তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কমিটিও কিছু ক্ষেত্রে এমনভাবে সম্পদের অপচয় ঘটাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের জমিজমা বা সম্পদাদি নিয়েও কিন্তু এরূপ কিছু ঘটে চলেছে। এই আলোচনাগুলো প্রসঙ্গবহির্ভূত মনে হতে পারে। তবে বেসরকারি স্কুল-কলেজশিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রশ্নে সরকারের নীতি পর্যালোচনা করতে প্রয়োজনীয় বটে।
বেসরকারি স্কুল-কলেজের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেল দেওয়া যে যুক্তিতে আটকে রাখা হচ্ছে, সেই বাস্তবতা তো আগেও ছিল। এ কারণে আগেরবারের বেতন স্কেল আটকে রাখা হয়েছিল, এমন তো নয়। এবার এটা করতে গিয়ে সরকার অকারণ সমালোচনার সম্মুখীন হবে। তাদের ‘শতভাগ’ বেতন-ভাতা দেওয়ার কথা হলে আক্ষরিক অর্থেই শতভাগ দিন। আর তা দেবেন সরকারি কর্মচারীদের মতো একই নিয়মে ও হারে। আর প্রতিষ্ঠান পরিচালনার খরচাদি বাদে বাকি আয় সরকারি কোষাগারে নিয়ে আসুন। এতে শিক্ষকেরা উৎসাহী হয়ে সহায়তাই করবেন। শতভাগের নামে শুভংকরের ফাঁকি চলতে থাকলে তাঁদের নিজস্ব আয়ের উৎসটি নিয়ে টানাহেঁচড়া না করাই ভালো। বরং নিরপেক্ষ শক্তিশালী অডিটের মাধ্যমে প্রকৃত অনিয়ম ও তার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যেতে পারে।
বেতন স্কেলটি চালুর মুহূর্তে ভয় হচ্ছে সরকারের এই উদারতা থেকে যাঁরা অন্যায্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। আমরা তো হরিষে বিষাদ চাই না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.