সহিষ্ণুতা ছাড়া গণতন্ত্র হয় না by কুলদীপ নায়ার

‘আমি মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ’—সোনিয়া গান্ধী কেন এ কথা বললেন, তার মর্ম আমি বুঝতে পারলাম না। ব্যাপারটা ছিল বিলুপ্ত পত্রিকা ন্যাশনাল হেরাল্ড-সংক্রান্ত, যে পত্রিকাটি সরকারের কাছ থেকে ৯০ কোটি রুপি ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেয়নি। ফলে আদালত এই ফেরত না দেওয়ার ঘটনাটিকে ‘অপরাধমূলক’ কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ওদিকে সোনিয়াপুত্র রাহুল গান্ধীও আদালতের এই রায়কে তাঁদের ও কংগ্রেস পার্টির বিরুদ্ধে মোদির ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা তো আদালতের সিদ্ধান্ত, এর মধ্যে সরকার এল কোত্থেকে?
রাহুলের এই কথায় জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে—এই আশঙ্কায় কংগ্রেস ভোল পাল্টেছে। দলটি আদালতের রায় থেকে রাহুলের মন্তব্যকে বিযুক্ত করার চেষ্টা করছে। ওদিকে কংগ্রেসের সাবেক আইনমন্ত্রী কপিল শিবাল রাহুলের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য সমর্থন করে বলেছেন, এটা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের প্রতিশোধ। দেখা যাচ্ছে, সোনিয়া ও রাহুল দুজনেই এই ঋণের প্রসঙ্গটির রাজনীতিকীকরণ করার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা আসলে এই ঋণ পরিশোধ করতে চান না। মা ও ছেলে উভয়ই মোদি ও বিজেপি সরকারকে অযথা এর মধ্যে টেনে এনেছেন।
সোনিয়া গান্ধী তাঁর শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধীর মতোই আচরণ করছেন। সোনিয়া ক্ষমতায় থাকলে হয়তো শাশুড়ির পদাঙ্কই অনুসরণ করতেন। তিনি হয়তো জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করতেন, তারপর হয়তো গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতেন এবং বিনা বিচারে লাখ খানেক লোককে জেলে পুরতেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টের সঙ্গে মামলায় হেরে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, আদালত তাঁকে ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য ছয় বছরের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। তখন তিনি লোকসভা থেকে পদত্যাগ না করে জরুরি অবস্থা জারি করেন আর নিজের অবৈধভাবে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটি জায়েজ করার জন্য ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে আইন সংশোধন করেন। সংসদও সেটা অনুমোদন করে। ওই সময় সংসদে কোনো বিরোধী দলই ছিল না। কারণ, তিনি বিরোধী দলের সাংসদদের গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা আর সংসদে বাগড়া দিতে না পারেন।
কংগ্রেস পার্টি আসলে এটা বুঝতে পারেনি যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারি দল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিরোধী দলও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হলে গণতান্ত্রিক কাঠামো আরও শক্তিশালী হয়।
কংগ্রেস পার্টি আসলে এটা বুঝতে পারেনি যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারি দল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিরোধী দলও গুরুত্বপূর্ণ এখন কথা হচ্ছে, মোদি সরকারের যত পাপই থাকুক না কেন, বহুত্ববাদের ধারণা বিনষ্ট করার লক্ষ্যে আগে যেসব আইন হয়েছে, তার জন্য তো বিজেপিকে দায়ী করা যায় না। তবে সামগ্রিকভাবে এর মূল দায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি), যার লক্ষ্য হচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এটা ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলিক ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গণতান্ত্রিক ভারত সংবিধানে স্থান দিয়েছে।
মোদি সরকারের ওপর আরএসএসের আছর আছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস বিজেপির নেই। যেমন, তারা বহুত্ববাদের গায়ে হাত দিতে চায় না। কারণ তারা জানে, অধিকাংশ ভারতীয়ই ধর্মনিরপেক্ষতার পাল্টা প্রপঞ্চ হিসেবে হিন্দুত্বকে গ্রহণ করবে না।
তবে এটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে মোদি সরকার ভারতে অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি করেছে, যার কারণে শুধু মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে দেশে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করার জন্য আরও আরও বিনিয়োগ দরকার, সে দেশকে ডানপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়া কাজের কথা নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে অভিনন্দন জানানো উচিত। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে অচলাবস্থা ছিল, তিনি সেটা ভেঙেছেন। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না করলে ভারত তার সঙ্গে কথা বলবে না—ভারতকে এমন কট্টর অবস্থান থেকে তিনি সরিয়ে এনেছেন। ভারতের স্বার্থেই তিনি নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে এসব পদক্ষেপ আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল, বহু বছর এমনিতেই নষ্ট হলো।
সারা দেশেই তাঁর উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। নয়াদিল্লি মানুষের আকাঙ্ক্ষার সম্মান দেয়, যে মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। সমস্যাটা পাকিস্তানের, সেখানে উগ্রপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর আধিপত্য আছে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করার ব্যাপারে ইসলামাবাদের ওপর চাপ রয়েছে। তারপরও এটা বুঝতে হবে যে এই বন্ধুত্বের বিকল্প নেই। সেটা আজ হোক বা কাল, এই দুই দেশের সামনে স্রেফ একটা সুযোগই রয়েছে। অবশ্য উভয় পক্ষেরই কিছু অংশ বিষয়টা বোঝে। কিন্তু তারা কমজোর, মৌলবাদীরা তাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
গত সাত দশক আমরা নিরর্থক অনেক কিছুই করলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সম্পর্কের মধ্যে বৈরিতার বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তান এ পর্যন্ত দুটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করেছে, তা ছাড়া কারগিলে তারা একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ করেছে। দুই পক্ষেরই হাজার হাজার সেনা মারা গেছে। কাশ্মীর হচ্ছে রোগের লক্ষণ, এটা রোগ নয়। এই রোগটা হচ্ছে আস্থার ঘাটতি। সময় এসেছে, এখন আমাদের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে এই দেশ দুটি প্রতিবেশীর মতো স্বাভাবিকভাবে বসবাস করতে পারবে।
এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূর করার জন্য পাকিস্তানকে পাঠ্যবই বদলাতে হবে, স্কুলের জন্য জারি করা পরিপত্র বদলাতে হবে। কথা হচ্ছে, হিন্দু মৌলবাদ ও মুসলিম মৌলবাদ একই জিনিস, তাদের মধ্যে পার্থক্য নেই।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.