বাংলাদেশের তড়িঘড়ি যোগদান কেন? by এ কে এম জাকারিয়া

সৌদি আরব গত মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘সামরিক জোট’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে ‘যৌথ অপারেশন সেন্টারের’ মাধ্যমে এই জোটের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে’ লড়াই করবে এই জোট। জোটের ৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। আছে লিবিয়াও। তবে বাদ পড়েছে তিনটি দেশ—ইরাক, ইরান ও সিরিয়া। শিয়া-সুন্নি বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পরিষ্কারভাবেই এটা একটি ‘সুন্নি’ জোট। আর জোটের লক্ষ্য হিসেবে সাধারণভাবে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ লড়াই বা এটা ‘শুধু ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকবে না’ বলা হলেও এর শুরুটা আসলে আইএসবিরোধী লড়াই না হয়ে উপায় নেই। সংগঠন হিসেবে আইএস সুন্নিপন্থী ও শিয়াবিরোধী হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ব কি তবে সামনের দিনগুলোতে সুন্নি সামরিক জোট ও সুন্নি আইএসের মধ্যে লড়াই দেখতে যাচ্ছে? যদিও এই ‘সামরিক’ জোট কীভাবে তাদের কাজ চালাবে বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
এমন একটি জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুব স্বাভাবিক কারণেই আমাদের জন্য আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়। এ ধরনের জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশের বিপদ বাড়বে কি না বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হুমকির মুখে পড়বে কি না, সেটা এক বাস্তব প্রশ্ন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এমনই একটি প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা। তিনি বলেছেন, সৌদি জোটে যোগ দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকির আশঙ্কা সৃষ্টি হবে না। তিনি বলেছেন, ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযান আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫)
সাধারণ যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে এটা আমরা বুঝতে পারি যে আইএস বা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনো দেশ যখন কোনো জোটভুক্ত হবে, তখন সেই দেশগুলো জঙ্গিদের বাড়তি টার্গেটে পরিণত হবে এবং এটাই স্বাভাবিক। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হুমকির আশঙ্কার মধ্যে পড়বে না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে তাই যৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। তবে এই জোটে যোগ না দিলে বা যোগ দেওয়ার আগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছ থেকে নিরাপদ ছিল, বিষয়টি এমনও নয়। প্রশ্নটি হচ্ছে, এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শক্তি বা সক্ষমতা আমাদের আছে কি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অনেক দেশই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা বা তাদের মোকাবিলা করতে পারেনি, কিন্তু আমরা পেরেছি।’
সৌদি আরবের উদ্যোগে এ ধরনের একটি জোট গঠনে যে পশ্চিমা দেশগুলোর সায় রয়েছে, তা পরিষ্কার। এই জোট গঠনকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের মাত্রাটি বিবেচনায় নিলে এটা ধরে নেওয়া যায় যে পশ্চিমাদের বুদ্ধি-পরামর্শ ছাড়া সৌদি আরব এ কাজ করেনি। আগেই বলেছি, মুসলিম দেশগুলোর এই সামরিক জোট কীভাবে কাজ করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সৌদি আরবের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহামেদ বিন সালমান এই জোটের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে এই জোট অন্যান্য দেশ ও সংস্থার সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে, তা সামনে ঠিক করা হবে।
সৌদি নেতৃত্বের এই জোটের অন্য শক্তিধর মুসলিম দেশগুলো হচ্ছে মিসর ও ন্যাটো জোটভুক্ত একমাত্র মুসলিম দেশ তুরস্ক। আইএসের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত। তুরস্ক আইএসের কাছ থেকে কম দামে তেল কেনে, কুর্দি বিদ্রোহীদের দমনে তাদের কাজে লাগায় এবং নানাভাবে সহযোগিতা করে—এসব অভিযোগের জোরালো ভিত্তির কথা বিভিন্ন মহল থেকে স্বীকৃত। এই জোটে তুরস্কের অংশগ্রহণ তাই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে শুরুতেই প্রশ্নের মুখে ফেলে। অন্যদিকে আইএস ইরাকের তিন ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড দখল করে রয়েছে অথচ জোটে রাখা হয়নি ইরাককে। অনেক সমালোচকই বলতে শুরু করেছেন যে সৌদি নেতৃত্বাধীন এই ‘সুন্নি জোটের’ মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-নিয়ন্ত্রিত ইরানের প্রভাবকে চাপের মধ্যে রাখা। সন্ত্রাস দমন বা সুন্নিপন্থী আইএসের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি জোট গঠনের কথা বলা হলেও এ ধরনের একটি জোট কার্যত মুসলিম দুনিয়ায় শিয়া-সুন্নি বিরোধকে আরও সক্রিয় করে তুলতে পারে।
তুরস্কের ইংরেজি ভাষার দৈনিক টুডে’জ জামান–এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুরস্কের প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক লোঘুঘলু বলেছেন, এই জোটে তুরস্কের যোগদান এ অঞ্চলে গোষ্ঠিগত সহিংসতাকে বাড়িয়ে দেবে। তিনি বলেন, এই জোট সুন্নিপ্রাধান দেশ বা সুন্নি শাসকদের দ্বারা শাসিত দেশগুলোর জোট, এই জোট আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর কিছু হবে না।
সৌদি উদ্যোগ প্রথমেই হোঁচট খেয়েছিল পাকিস্তানের বক্তব্যে। সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে ৩৪টি মুসলিম দেশের জোট ঘোষণা দেওয়ার পর পাকিস্তান বলেছে যে এ ধরনের একটি জোটের ব্যাপারে তারা কিছু জানে না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পাকিস্তানি পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে (ডিসেম্বর ১৬) বলেছেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের খবরে বিষয়টি দেখেছি। আমরা সৌদি আরবে আমাদের দূতাবাসকে বিস্তারিত জানতে বলেছি।’ তিনি বলেছেন, সৌদি ঘোষণা ছিল পাকিস্তানের কাছে অপ্রত্যাশিত। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন তথ্যই পেয়েছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই কেন্দ্রে যোগ দিতে রাজি হয়েছেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন (১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫) বলছে, এই আলোচনার পর সৌদি আরব ই-মেইল করে বাংলাদেশকে প্রস্তাবটি পাঠিয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কি তবে সৌদি আরব ভিন্ন আচরণ করেছে?
দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে পাকিস্তান সরকারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, নীতিগতভাবে পাকিস্তান কখনো জাতিসংঘের সমর্থনের বাইরে কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। যে কারণে ইয়েমেনে সৌদি অভিযানের সময় পাকিস্তান এতে যোগ দেয়নি। তিনি বলেছেন, নতুন কোয়ালিশনে যোগ দিলেও পাকিস্তান কখনো বিদেশের মাটিতে তাদের সৈন্য পাঠাবে না। এই পাকিস্তানি কর্মকর্তা অবশ্য তাঁর নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। মুসলিম দেশগুলোর সামরিক জোটে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ নিয়ে বিভ্রান্তি ও রাখঢাকের এক দিন পর অবশ্য পাকিস্তান নিশ্চিত করেছে যে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ তারা সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে রয়েছে। বোঝা যায়, সৌদি কোনো উদ্যেগকে চূড়ান্ত বিচারে না করা পাকিস্তান তো বটেই, যেকোনো মুসলিম দেশের জন্যই কঠিন। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় বলেছে, কীভাবে পাকিস্তান এতে অংশ নেবে, তা নির্ভর করবে রিয়াদ কীভাবে এই জোটের গঠনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সে ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার পর। (ডন, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫)।
পাকিস্তানের এই অবস্থান ও প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গেল যে এ ধরনের একটি জোটে অংশগ্রহণ নিয়ে দেশটির অন্তত আগ-পিছ বিবেচনার একটি ব্যাপার রয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত এই সামরিক জোটে না থাকার কথা বলেছে সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। সৌদি ঘোষাণায় দেশটির নাম থাকলেও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, এই জোটের ব্যাপারে তাঁরা বিস্তারিত কিছু জানেন না এবং সে কারণে তাঁরা জোটে নেই। (জাকার্তা পোস্ট, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫)। ইন্দোনেশিয়া বলেছে, নীতিগতভাবে দেশটি জাতিসংঘের বাইরে অন্য কিছুর অধীনে কোনো সামরিক মিশনে যোগ দেয় না।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর বৈশ্বিক লড়াইয়ে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই বাইরে থাকতে পারবে না, কিন্তু এর আগ-পিছ বিবেচনা করে দেখা বা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুবই জরুরি। শুরুতেই যেটা জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে, এটা যেহেতু একটি ‘সামরিক জোট’, তাই সদস্যদেশগুলোকে কি দরকার পড়লে ইরাক বা সিরিয়ার মতো দেশে বা আইএস-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সামরিক অভিযানে অংশ নিতে হবে? জোটের সদস্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশের এটা জানা জরুরি যে কোন ধরনের সামরিক ভূমিকা দেশটিকে পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন ও মেইল করে ‘প্রস্তাব’ পাঠানোর পরই বাংলাদেশ রাজি হয়ে গেল! একটি সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তা খুবই তড়িঘড়ি হয়ে গেল না? বাংলাদেশ সরকার যতই বলুক কোনো সামরিক জোট নয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি কেন্দ্রে যুক্ত হয়েছে মাত্র—কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সৌদি ঘোষণায় একে পরিষ্কারভাবেই একটি ‘সামরিক জোট’ বলা হয়েছে। এই জোট ঘোষণার দুই দিন পরই আইএসের তরফে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে এবং তারা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে।
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের যোগ দেওয়া সংবিধানের পরিপন্থী। তিনি বলেছেন, এটা সংবিধানের ২৫ ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। (প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫) কী বলছে আমাদের সংবিধানের ২৫ ধারা? ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা—এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’ ফজলে হোসেন বাদশা তাঁর ব্যাখ্যায় বলেছেন, সংবিধানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির কথা বলা হয়েছে। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নীতি আমাদের নেই।
সরকারের শরিক দলের এই ভিন্ন অবস্থানকে ব্যাখ্যার দায়টি সরকার নেবে কি?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.