বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে দু’দেশেরই সংবাদমাধ্যম

কূটনৈতিক অভিধান তন্নতন্ন করেও এহেন অপ্রত্যাশিত দৌত্য খুঁজে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। শুক্রবার যেমনটার সাক্ষী থাকল এই উপমহাদেশ। আজ সকালে ফোনে নওয়াজ শরিফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তার আমন্ত্রণে দিল্লি ফেরার পথে সটান লাহোরে পৌঁছে গেলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নওয়াজের বাসভবন রাইওয়ান্দ প্যালেসে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়ে ফিরলেন তিনি। তারই মধ্যে সারলেন পাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক। যার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বলেছেন, ‘‘শোরগোলের বাইরে এ এক ব্যক্তিগত যোগাযোগ।’’ কিন্তু এই ‘ব্যক্তিগত যোগাযোগের’ আবহটি ছিল এতই অপ্রত্যাশিত যে তার ধাক্কায় বিশেষণ হারিয়ে ফেলেছেন উপস্থিত ধারাভাষ্যকাররা। আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে সময় নিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গাছে ওঠা গল্পের গরু-সম চিত্রনাট্যও হার মেনে গিয়েছে মোদির এই চূড়ান্ত ‘আউট অব দ্য বক্স’ চালে। আজ দিনটিও তো বড় সামান্য নয়। একে শীতার্ত বড়দিনের বেলা। তায় পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিন। আর এই শরিফের সঙ্গে, এই লাহোরেই মৈত্রীর চাকা গড়িয়েছিলেন যিনি, সেই অটলবিহারী বাজপেয়ীরও জন্মদিন বটে। পাশাপাশি আজই কাবুলে প্রাতরাশ সেরেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী (যা ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিংহের স্বপ্ন, লাহোর এবং কাবুলে যথাক্রমে প্রাতরাশ এবং মধ্যাহ্নভোজের)। এমন দুর্লভ সন্ধিক্ষণে যেন খোদ সান্টাক্লজ হয়ে পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখলেন মোদি! বৈকালিক নাশতাটি প্রধানমন্ত্রী সারলেন লাহোরে! আর আজ বেলা পর্যন্ত কাবুল-দিল্লি-ইসলামাবাদের কাক-চিড়িয়াও টের পেল না গত ৬৭ বছর ধরে সংঘর্ষক্লান্ত দু’টি দেশের রাষ্ট্রনায়ক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি হচ্ছেন। টের পেল না যে বহু কূটনৈতিক প্রয়াস ও অভিপ্রায় থাকা সত্ত্বেও যে দেশে গত দশ বছরে পৌঁছতে পারেননি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সেখানে একটি ফোন-আমন্ত্রণে অক্লেশে পৌঁছে যাবেন মোদি। লাহোর বিমানবন্দর থেকে সটান চলে যাবেন নওয়াজের বাসভবন রাইউইন্দ প্যালেসে। ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অবশ্য গত কয়েক সপ্তাহ সাক্ষী থাকছে নানা রকম আকস্মিকতার। প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে হঠাৎ করেই লাউঞ্জে নওয়াজের সঙ্গে একান্তে প্রায় দশ মিনিট কথা বলেন মোদি। এর কোনো পূর্বাভাস ছিল না। আর তার পরেই চূড়ান্ত গোপনে ব্যাঙ্ককের মতো একটি শহরে দু’দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টারা থমকে যাওয়া আলোচনা শুরু করলেন. এটাও ছিল কিছুটা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সে সবকে ছাপিয়ে গিয়েছে শুক্রবারের এই ঘটনা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া এই সফর অসম্ভব। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ‘ব্যাকরুম চ্যানেলে’ শুরু হয়ে গিয়েছিল এই মহাবৈঠকের প্রস্তুতি। কিন্তু সে তো পর্দার আড়ালে। শুক্রবার দুপুর থেকে প্রকাশ্যে যা দেখা গেল তা যেন দুই যুযুধান রাষ্ট্রনায়ক নয়, পাশাপাশি পাড়ায় থাকা দুই বন্ধুর স্বচ্ছন্দ আচরণ। মোদি এবং নওয়াজের টুইট অনুযায়ী, শুক্রবার সকালে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে প্রধানমন্ত্রী কাবুল থেকে ফোন করেন পাক রাষ্ট্রপ্রধানকে। ধন্যবাদ জানিয়ে নওয়াজ শরিফ বলেন যে তিনি তো লাহোরে নিজের বাড়িতেই রয়েছেন। ফেরার পথে একবার ঘুরে যান না কেন মোদি! সঙ্গে সঙ্গেই আমন্ত্রণ স্বীকার করে মোদি জানান তিনি আসছেন! এরপর ফের টুইটে মোদি লেখেন, ‘‘আজ বিকেলে নওয়াজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে। দিল্লি ফেরার পথে যাচ্ছি সেখানে।’’ প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে দু’দেশেরই সংবাদমাধ্যম। শুক্রবার জন্মদিনের নানাবিধ অনুষ্ঠান ছিল নওয়াজের। তাছাড়া রাইউইন্দ প্যালেসে আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে নওয়াজের নাতনি মেহেরুন্নিসার বিয়ের উৎসব। সমস্ত কাটছাঁট করে সাদা পাঠান স্যুট পরে বিমানবন্দরে লোকলস্কর নিয়ে হাজির হয়ে যান পাকিস্তানের উজির-এ-আজম। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষাও করেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়া-১৩৪ বিমানটি টারম্যাক ছুঁতেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কিন্তু নাটকের তখনও কিছু বাকি ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে আসছেন, এই খবরটি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নওয়াজ শরিফের অফিস সূত্রে জানানো হয়েছিল বিমানবন্দরেই কিছুক্ষণ থাকবেন তিনি। সেখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে যাবেন দিল্লি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, গেরুয়া কুর্তা-পাজামা পরিহিত সহাস্য মোদি একাই তরতর করে নেমে আসছেন বিমানের সিঁড়ি দিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে, যেখানে কার্যত উদ্বাহু হয়ে অপেক্ষায় শরিফ। দু’জনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন, উপস্থিত কর্তাদের সঙ্গে করমর্দনও হলো। এরপর দুই নেতা হাত ধরাধরি করে লাল কার্পেট মাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন অদূরে অপেক্ষারত হেলিকপ্টারের দিকে! তখন জানা গেল, বিমানবন্দরে বন্দি হয়ে থাকতে আসেননি মোদি। তাকে নিয়ে নিজের বাসভবনে পৌঁছলেন শরিফ। মোদি নিরামিষাশী, তাই তার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল মখমলি পনির, বেসনের বড়া, গাজরের হালুয়া-সহ বিভিন্ন পদের। ব্যাগে শুধু নওয়াজের জন্মদিনের উপহারই আনেননি, জানা গিয়েছে নাতনি মেহেরুন্নিসার জন্যও তিনি নিয়ে এসেছেন শাড়ি শাদির-তোফা হিসাবে।   ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রের খবর, গত বছর শুরু হয়েও পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ার পর, পাক প্রশ্নে এ বার যথেষ্ট কৌশলী এবং সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে মোদি সরকার। প্রথমত, শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বই নয়, একটি সমান্তরাল আলোচনার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গেও। এই মুহূর্তে যিনি সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সেই নাসির খান জানুজা এসেছেন সেনাবাহিনী থেকেই। তিনি ছিলেন পাক সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল। এই মুহূর্তে পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের সঙ্গে তার যোগাযোগ যথেষ্ট ভালো। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ব্যাঙ্ককে এই জানুজার সঙ্গেই দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। সেই আলোচনা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এক কূটনীতিকের কথায়, ‘‘মোদি যে পাকিস্তানের সঙ্গে এত দ্রুত আলোচনার গতি বাড়িয়ে চলেছেন তার পিছনে পাক সেনার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাক সেনা কিছুটা কৌশলগত ভাবে স্থিতিস্থাপকতা (স্ট্র্যাটেজিক্যালি স্ট্রেচড) দেখাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।’’   পাশাপাশি, বর্ষশেষে তার এই কৌশলী চালের ফলে দেশের অভ্যন্তরেও একটি বার্তা মোদি পৌঁছতে চেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে তার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। চলছে তুমুল বিতর্ক। এমন সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে, সেখানে খানা খেয়ে আসার এই পদক্ষেপ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অংশকে খুশি করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তার এই আচরণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছেও একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেবে বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।   পাশাপাশি, এই সফরের মধ্যে একটি বন্ধুত্বের বাতাবরণ তৈরি করলেও, সেটি করা হয়েছে এতটাই আকস্মিক ভাবে যেকোনো প্রত্যাশার চাপ তৈরি হওয়ার সুযোগই দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া, রাষ্ট্রীয় সফরে যেমন দ্বিপাক্ষিক দেনাপাওনার হিসাব ও প্রত্যাশা থাকে, যৌথ বিবৃতির শব্দচয়ন নিয়ে বিবৃতির ঝড় ওঠে, এই ধরনের সৌজন্য সফরে তেমনটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। এখানে কাশ্মির নিয়ে একটি শব্দও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করার প্রয়োজন পড়ে না, অথবা সাংবাদিক সম্মেলনও হয় না। ফলে মোদির এহেন সফরে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারেরও অখুশি হওয়ার কোনো কারণ থাকছে না।   কটূক্তি কংগ্রেসের বিজেপির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর লাহোর যাওয়ার পরিণাম হয়েছিল কার্গিল। এবার কী হবে? শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাহোর সফর নিয়ে এই ভাষাতেই কটূক্তি করলেন কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়াড়ি।   যদিও পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই এই লাহোর গমন বলে দাবি জানিয়েছেন মোদি। কিন্তু বিরোধীরা এর তীব্র সমালোচনা করেন। মোতির লাহোর সফরের খবর প্রকাশ্যে আসতেই ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় ট্যুইট করেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়াড়ি। ট্যুইটারে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসিক কূটনীতির সবচেয়ে খারাপ অভিব্যক্তি হলো লাহোর। গতবার বাজপেয়ী লাহোরে যাওয়ার পর কার্গিল হয়েছিল! এবার কী হবে?’’ প্রধানমন্ত্রী বা তার দলের তরফে এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে মোদির এই সফরকে সঠিক পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন জম্মু-কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী মুফ্‌তি মুহম্মদ সাঈদ।  - সংবাদমাধ্যম

No comments

Powered by Blogger.