বাংলাদেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত : ওয়াশিংটনে ব্রিফিং by ইমরান আনসারী

বাংলাদেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভূলণ্ঠিত। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সরকারকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রকাশ সেন্সরশিপের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে আবার কেউ কেউ গুম হয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম লেন্টুস হিউম্যান রাইটস অর্গানইজেশন আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন বক্তারা।
গত সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ওয়াশিংটনের রেভন হাউস অফিস বিল্ডিংয়ে ব্রিফিংটি অনুষ্ঠিত হয়। দেশে ধর্মীয় জঙ্গীবাদের বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ওই আলোচনায়। এছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের আরো জোড়ালো ভূমিকা রাখার আহ্বান আসে ব্রিফিংয়ে অংশ নেয়া বক্তাদের বক্তব্যে।
সেন্টার ফর ইনকোয়ারির পরিচালক মিখাইল ডোরার সঞ্চালনায় ব্রিফিংয়ে উদ্ধোধনী বক্তব্য দেন টম লেন্টুস হিউম্যান রাইটস অর্গানইজেশনের কো-চেয়ার কংগ্রেসম্যান জেমস পি মেকগভার্ন। প্যানালিস্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন নিহত ব্লগার অভিজিত রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহম্মেদ বন্যা, ইউএস কমিশন ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এর সিনিয়র পলিসি এনালিস্ট সাহার চৌধুরী, পেন আমেরিকান সেন্টারের পরিচালক কারিন ডাট্চ কার্লিকার, আটলান্টিক কাউন্সিল সাউথ এশিয়ান সেন্টারের পরিচালক ভারত গোপাল স্বামী।
উদ্বোধনী বক্তব্যে কংগ্রেসম্যান জেমস পি মেকগভার্ন বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নাগরিক সমাজ প্রায়ই রোষানলে পড়ছে। বিরোধী দলের বিক্ষোভ সমাবেশ হয় আইনশৃংখলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে অন্যথায় ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় গণগ্রেফতার করার পাশাপাশি গ্রেফতার হওয়াদের লাশ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। আর এসব বিষয় যখনই মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা ব্যাক্তিবর্গ ডক্যুমেন্ট আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করে তখনই হয় তারা হুমকির সম্মুখীন হন আর না হয় কারাবরণ করেন। কোনো কোনো সময় নির্যাতনের স্বীকার হন।
গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় সভা সমাবেশ ও মতপ্রকাশের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন, সমাবেশ একটি স্বার্থক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উপাদান। কারণ বৈচিত্রপূর্ণ জনগোষ্ঠী ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্রই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট সুযোগ।
সম্প্রতি উগ্র ধর্মীয় জঙ্গীবাদের উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করে মেক গভার্ন বলেন, আল কায়দা ও আইএসআইএস’র মতো বহুজাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বাংলাদেশে অবস্থানের সংবাদ দেশটির স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রকে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সম্প্রতি কার্যকর হওয়া দুই বিরোধী দলীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মেক গভার্ন বলেন, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও ফাঁসি কার্যকর না করার জন্য আহবান জানানো হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের আহ্বানকে আমলে নেয়া হয়নি।
মিখাইল ডি ডোরা সূচনা বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি গত দুই বছরে খুবই খারাপ হয়েছে। পরিস্থিতি এতোই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সেখানে ভুলুণ্ঠিত। সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরণের প্রতিবাদ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে করা সমালোচনা সেন্সর করা হচ্ছে। কোনো কোনো লেখককে গ্রেফতার করা হচ্ছে অনেকসময় গুম হয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে আইএএসের অস্তিত্ব নিয়ে সরকারের বক্তব্যের সমালোচনা করেন তিনি। দেশে সংখ্যালঘুদের উপর অব্যাহত হামলার বিষয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেন মি. মিখাইল।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহম্মেদ বন্যা বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগার, সাংবাদিক ও প্রকাশকদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তুলে ধরেণ।
তার মতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধুমাত্র ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়। এক্ষেত্রে সরকারও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংশোধিত আইসিটি অ্যাক্টকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বড় বাধা বলে মনে করেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে বিবেচনা করার বিরোধীতা করেন রাফিদা আহম্মেদ। একটি কার্যকর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ বিনির্মানে সর্বোপরি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধভাবে সহযোগিতা করার আহবান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন মাহবুব হাসান সালেহ এ আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন।
এক ঘণ্টা স্থায়ী এ আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বক্তারা কংগ্রেস সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
প্রাক্তন কংগ্রেসম্যান ও কংগ্রেসনাল হিউম্যান রাইটস ককাসের প্রাক্তন সভাপতি টম ল্যান্টসের নামানুসারে গঠিত টম ল্যান্টস হিউম্যান রাইটস কমিশন মার্কিন কংগ্রেসের একটি অঙ্গ সংস্থা। বহুপক্ষীয় এই কমিশন নির্দলীয় ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা ও মতবিনিময়ের আয়োজন করে থাকে।
কমিশন ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানি ও আলোচনার আয়োজন করতে পারে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.