ভারতে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: সম্মাননা ফেরত দিলেন ৪১ লেখক by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়নতারা সায়গল, দলীপ কৌর তিওয়ানা
ভারতে সার্বিক অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে গত চার-পাঁচ দিনে ৪১ জন লেখক-সাহিত্যিক সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার ও সম্মাননা ফেরত দিয়েছেন। এ নিয়ে ভারতজুড়ে চলছে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক।
এ ব্যাপারে চুপ থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, বিজেপি এ ধরনের ঘটনা সমর্থন করে না। বিরোধীরা এসব ঘটনাকে সামনে এনে মেরুকরণের রাজনীতি করছেন। আনন্দবাজার পত্রিকাকে তিনি বলেন, অতীতেও এই বিতর্ক হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বিতর্কের নিরসন সম্ভব।
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারজয়ী যুক্তিবাদী কন্নড় লেখক এম এম কুলবর্গি কর্ণাটকে নিজের বাড়ির কাছে খুন হন গত ৩০ আগস্ট। এর আগে খুন হয়েছেন যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসার ও নরেন্দ্র দাভোলকর। সনাতন সংস্থা নামে এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এসব হত্যার পেছনে রয়েছে বলে তদন্তকারী সংস্থার সন্দেহ। সংগঠনের একাধিক সদস্যকে এ জন্য গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বাক্-স্বাধীনতার ওপর এই আক্রমণ সত্ত্বেও সাহিত্য আকাদেমি প্রতিবাদ না জানিয়ে চুপ থাকায় বিশিষ্ট লেখিকা জওহরলাল নেহরুর ভাগনি নয়নতারা সায়গল সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। ফেরত পাঠান এক লাখ রুপি পুরস্কারমূল্যও।
সেই থেকে বিভিন্ন ভাষার ৪১ জন লেখক-লেখিকা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার কিম্বা খেতাব ফেরত পাঠিয়ে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছেন। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের কবি মন্দাক্রান্তা সেন ও পাঞ্জাবি লেখিকা দলীপ কৌর তিওয়ানা। গৌতম বুদ্ধ ও গুরু নানকের দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং তা রুখতে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে সরকারি পদ্মশ্রী খেতাব ফেরত দিয়ে তিওয়ানা বলেছেন, যা হচ্ছে তা দেশের পক্ষে লজ্জার।
শুধু যুক্তিবাদী লেখক খুনই নয়, প্রতিবাদী লেখকেরা সার্বিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে গলা তুলেছেন। তাঁরা মনে করছেন, রাজ্যে রাজ্যে ও কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই অসহিষ্ণুতা মাত্রাছাড়া হয়ে গেছে। নয়নতারা সায়গল অথবা কন্নড় লেখক রহমত তারিকেরি কিংবা মন্দাক্রান্তা সেন উত্তর প্রদেশের দাদরি এলাকার বিসাদা গ্রামে গোমাংস খাওয়ার অপরাধে মুহম্মদ ইকলাখকে পিটিয়ে মেরে ফেলার প্রসঙ্গও তুলেছেন। তাঁরা মনে করেন, এই সহিংসতা বন্ধে শাসক দল ও রাষ্ট্রের যে ভূমিকা পালন করা দরকার, তা করা হচ্ছে না। নয়নতারার অভিযোগ, সাহিত্যিকদের হত্যা করা হচ্ছে অথচ সাহিত্য আকাদেমি নীরব দর্শক সেজে থাকবে, কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত করবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সারা জোসেফ
নয়নতারার পুরস্কার ফেরানোর ঘটনায় কটাক্ষ করে আকাদেমির চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ প্রসাদ তিওয়ারি পুরস্কারমূল্য ফেরত দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরদিনই নয়নতারা এক লাখ রুপির একটা চেক সাহিত্য আকাদেমিতে পাঠিয়ে দেন। সাহিত্যিক সালমান রুশদি নিজের বিরক্তি গোপন না করে বলেছেন, ‘আমি ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলকেই সমর্থন করি না। বাক্-স্বাধীনতার ওপর সব ধরনের আক্রমণের নিন্দা করি। মনে হচ্ছে, ভারতে এক নতুন হিংসার রাজনীতি জন্ম নিয়েছে।’ এই প্রতিবাদকে বিজেপি অবশ্য আমল দিচ্ছে না। বরং প্রধানমন্ত্রী সংবাদপত্রে মুখ খুলে যে প্রশ্নটা রেখেছেন, বিজেপির বড়-মেজ-ছোট নেতারাও সেই যুক্তিই খাড়া করছেন। ইকলাখ হত্যা অথবা পাকিস্তানি গজল গায়ক গুলাম আলীকে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়াকে দুঃখজনক জানিয়ে মোদির প্রশ্ন, এসব ঘটনার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক কী? এ প্রশ্নই তুলেছেন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী বিজেপি নেতা মহেশ শর্মা। তাঁর বক্তব্য, সাহিত্য আকাদেমি সরকারি সংস্থা নয়, স্বশাসিত সংস্থা, লেখকদের সংস্থা। লেখকেরাই এখানে দেশের লেখকদের পুরস্কার দেন। সেই পুরস্কার কেউ ফেরত দিলে সেটা তাঁদের ব্যাপার। বিজেপির সাংসদ বিজয় গোয়েল অবশ্য এতটা মোলায়েম স্বরে প্রতিবাদীদের সমালোচনা করেননি। তাঁর কথায়, লেখকেরা বরং তাঁদের কলমের দিকে নজর দিন। না হলে তাঁরা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবেন।
মন্দাক্রান্তা সেন, অশোক বাজপেয়ী
বিজেপির আমলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে, ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্র নষ্ট হয়ে হিন্দুত্ববাদী হওয়ার পথে এগোচ্ছে বলে প্রতিবাদী লেখক-লেখিকারা মনে করছেন। এঁরা মনে করছেন, গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণ, যুক্তিবাদীদের হত্যা, ইকলাখ-হত্যাকাণ্ড, পাকিস্তানিদের অনুষ্ঠানে বাধা দান, সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপে দেওয়া—এগুলো আদৌ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতকে ক্রমশ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার সার্বিক ছকের অঙ্গ এসব ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট, বিজেপি এই প্রতিবাদকে রাজনৈতিক মনে করছে। তারা মনে করছে, কংগ্রেস আমলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাঁরা ছরি ঘুরিয়ে এসেছেন, যাঁরা প্রকারান্তরে নেহরু-গান্ধী পরিবারের দাক্ষিণ্য পেয়েছেন, তাঁরাই আজ প্রতিবাদী। বিজেপি তাই রাজনৈতিকভাবে এই প্রতিবাদের মোকাবিলায় নেমেছে। বিজয় গোয়েল সে কারণেই বলেছেন, ‘আমরা চাই এই দাক্ষিণ্যভোগীরা দ্রুত পদ ছাড়ুন।’
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ফেরত দেওয়া নিয়ে লেখক মহলও দ্বিধাবিভক্ত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের লেখক মহল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সমরেশ মজুমদার, নবনীতা দেবসেন, সুবোধ সরকাররা মনে করেন, যে সরকার ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়াচ্ছে, তাদের আমলে তাঁরা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাননি। তাই পুরস্কার ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তাঁরা সবাই মনে করেন, সাহিত্য আকাদেমি কোনো সরকারি সংস্থা নয়। তাই পুরস্কার ফেরত দেওয়াটা সার্বিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঠিক পথ বলে তাঁরা মনে করেন না।

No comments

Powered by Blogger.