গণপরিবহনের নৈরাজ্য: চতুর্মুখী ভোগান্তি যাত্রীরা জিম্মি by রুদ্র মিজান

রাজধানীতে অসহনীয় এক দুর্ভোগের নাম গণপরিবহন। পরিবহন সংকট, বাড়তি ভাড়া, কথায় কথায় ধর্মঘট, যখন-তখন দুর্ঘটনা। চতুর্মুখী দুর্ভোগে সাধারণ যাত্রীরা। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর পর এ খাতে শুরু হয়েছে নতুন করে নৈরাজ্য। শতকরা ৪০ ভাগ যানবাহনেই অনেকটা জোরপূর্বক যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বিষয়টি যোগাযোগমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন। এই অভিযোগে ইতিমধ্যে অনেক গণপরিবহনকে দণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু কোন কিছুতেই ভাড়া নিয়ে এই বাড়াবাড়ি থামানো যাচ্ছে না। বরং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার প্রতিবাদে কয়েক ঘণ্টা ধর্মঘট করেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। রাজধানীর অভ্যন্তরে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলোতে গত ১লা অক্টোবর থেকে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কিলোমিটার প্রতি ১০ পয়সা করে ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও পরিবহন শ্রমিকরা তা মানছেন না। এমনকি ভাড়ার তালিকা পর্যন্ত টানানো নেই অনেক যানবাহনে। যাত্রীদের একধরনের জিম্মি করে তারা ভাড়া আদায় করছেন দ্বিগুণ হারে। এ অবস্থায় ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল গাবতলী থেকে আট নম্বর বাসে উঠেন আশিকুর রহমান। একটি  কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করেন তিনি। বাসে ওঠার পর কিছুক্ষণ পরেই ভাড়া খুঁজে চালকের সহযোগী কামাল। ২৫ টাকা এগিয়ে দিলে চটে যায় কামাল। এই মামা এইডা কি দিলেন, গ্যাসের দাম বাড়ছে, ভাড়া বাড়ছে খবর নাই? বিরক্ত হয়ে টাকাসহ ম্যানিব্যাগটি প্যান্টের পকেটে রেখে দেন আশিকুর। আশিকুর জানান, তিনি প্রায়ই এই রুটে চলাচল করেন। যাত্রীপ্রতি গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত তারা আগে ভাড়া নিতো ২৫ টাকা। এখন ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে ৩৫ টাকা দাবি করছে তারা। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পল্লবী থেকে বাসে উঠেছিলেন বৃদ্ধ নুরুল হক। বাস চালকের সহযোগী তার কাছে ৩৫ টাকা দাবি করেন।  নুরুল হক ভাড়া দিতে না চাইলে তাকে নেমে যেতে বলেন চালকের সহযোগী। তখন কয়েক যুবক প্রতিবাদ করেন। জানা গেছে, পল্লবী থেকে শাহবাগের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটারের বাসের ভাড়া ১.৭০ পয়সা করার কারণে এর ভাড়া দাঁড়ায় প্রায় ২৭ টাকা। কিন্তু এ বিষয়ে অবগত না অনেকেই। যাত্রীরাও জানেন না কত ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। কোন স্থান থেকে কোন স্থানের দূরত্ব কতটুকু। তবে এসব জানা থাকলেও কাজ হয় না। পরিবহন শ্রমিকরা এক ধরনের জিম্মি করেই ভাড়া আদায় করেন বলে জানান যাত্রীরা। সুপ্রভাত পরিবহনের ভাড়া আদায় নিয়ে চালকের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে গতকাল দুপুরে। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত আগে ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। চালকের সহযোগী ২০ টাকা দাবি করতেই চটে যান কয়েক তরুণ। তারা কিছুতেই জনপ্রতি ২০ টাকা দিতে ইচ্ছুক না। একপর্যায়ে ওই তরুণদের রামপুরায় নেমে যেতে বলেন চালকের সহযোগী। এ নিয়ে চালকের সহযোগীর সঙ্গে মারধরের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে চালক ও অন্যান্য যাত্রীদের সহযোগিতায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসে। যাত্রীদের মধ্যে পোশাক শ্রমিক নুরুন নবী মাসুম জানান, পরিবহন শ্রমিকরা কথায় কথায় বলে গ্যাসের দাম বাড়ছে, চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ছে। তিনি বলেন, বেতনতো বাড়ছে সরকারি চাকরিজীবীদের। তারা নিজের গাড়িতে চড়ে। আমাদেরতো বেতন বাড়েনি। আমরা বাসে চড়ি। অথচ এক লাফে বাসের ভাড়া বেড়ে গেছে। এভাবে ব্যয় বাড়লে আমরা বাঁচবো কিভাবে বলে হতাশা প্রকাশ করেন এই পোশাক শ্রমিক।
সরজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি রুটেই ইচ্ছামতো বাস ভাড়া আদায় করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। শ্যামলী থেকে ফার্মগেট যেতে আগে যাত্রীপ্রতি ভাড়া নেয়া হতো পাঁচ টাকা। এখন সেখানে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে আট টাকা। মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল যেতে এটিসিএল পরিবহনে আগে ভাড়া নেয়া হতো ২০ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। এটিসিএল বাসে প্রেস ক্লাব থেকে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত আগে ভাড়া ছিল ১০ টাকা, এখন ১৫ টাকা। মতিঝিলের  একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আবদুর রহমান জানান, তিনি হেমায়েতপুর থেকে প্রায় প্রতিদিন মতিঝিলে যাতায়াত করেন। আগে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে আসা গেলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। ভাড়া বৃদ্ধির পর এই ২১ কিলোমিটারের দূরত্বে কয়েক দিন ৪০ টাকা করে আদায় করেছে পরিবহন শ্রমিকরা। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পর ৩৬ টাকা করে আদায় করছে তারা।
ভাড়া নিয়ে লাগামহীন এই নৈরাজ্যের বিষয়টি অবগত হয়ে গত ১৪ই অক্টোবর অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া বাস মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বলেন, প্রায় ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারপরেই রাজধানীর বিভিন্ন রুটে শুরু হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯শে অক্টোবর রাজধানীর চারটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিআরটিএ। এ সময় ৭৮টি মামলা করা হয়। জরিমানা আদায় করা হয় ৭১ হাজার টাকা। তার আগে ১৮ই অক্টোবর তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৯৩২০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। মামলা করা হয় ৬৫টি। সম্প্রতি ভাড়া বৃদ্ধির পর অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে ১৫ই অক্টোবর প্রথম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ওই দিন তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৪৪টি মামলা ও ৫৭১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। ওই দিন তিন পরিবহন শ্রমিককে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই অভিযানের প্রতিবাদে রোববার ধর্মঘট করেন পরিবহন শ্রমিকরা। আগারগাঁও এলাকার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সামনে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত মিরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জগামী হিমাচল পরিবহনের চালকের সহকারীকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন। এর জের ধরে এই ধর্মঘট করেন তারা। এতে করে সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার হন যাত্রীরা। পরিবহন শ্রমিকদের এই আচরণকে সন্ত্রাসী কায়দা বলে অভিহিত করেছেন যাত্রীরা।
এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নিম্নমানের সেবা দিয়ে আগে যে ভাড়া ছিল তাও ছিল অযৌক্তিক। আবার নতুন করে ভাড়া বাড়িয়ে যাত্রীদের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে সরকার। এখন প্রতিদিনই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কে কেন্দ্র করে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের তর্ক বিতর্ক এমনকি হাতা-হাতি, মারামারির ঘটনা ঘটছে। এসব যানবাহনে যাত্রী সেবার লেশ মাত্র নেই। কথায় কথায় তারা ধর্মঘটেরও ডাক দেন। যাত্রীদের একধরনের জিম্মি করে তারা ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির উদ্যোগে গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সকল মহলের মতামত উপেক্ষা করে সরকার কোন প্রকার গণশুনানি না করে একতরফাভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। সরকার বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির অবৈধ আবদার রক্ষায় বিআরটিএ ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ আশপাশের জেলায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ভাড়া যাত্রী প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু মালিকরা চিরাচরিত কায়দায় কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে রীতিমত জোরপূর্বক যাত্রীদের নিকট থেকে আদায় করে যাচ্ছে। এতে করে নগরীর নিম্ন আয়ের প্রতিটি নাগরিকের যাতায়াত ব্যয় ১৫০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ দিনাতিপাত করতে দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে বলে জানান বিআরটিএ কর্মকর্তারা। বিআরটিএর পরিচালক বিজয় ভূষণ পাল বলেন, বিভিন্ন রুটে সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যেসব পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়ায় আদায় করছে তাদের বিরুদ্ধেই ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.