পুতিনের সাতকাহন by কায়কোবাদ মিলন

একবিংশ শতাব্দী রাশিয়া কিভাবে শেষ করবে? আবার ব্যক্তি শাসনের ধারায় চলে যাবে রাশিয়া! প্রায় ১৫ কোটি মানুষের দেশে কোনো স্থায়ী রাজনৈতিক দল নেই। ফলে ভোটারদের সংগঠিত করা এবং ভোটদান নিশ্চিত করা অসম্ভবের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিকে সেনাবাহিনীর অবস্থা হামাগুড়ি দেয়ার মতো এবং তারা তাদের স্বাভাবিক হিংস্রতা ত্যাগ করেছে বলেই মনে করা হয়। তবে দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হচ্ছে সিক্রেট পুলিশ। আর এই বাহিনী এক ব্যক্তির পকেটে। দেশটির হাইড্রোকার্বন সেক্টর ব্যক্তিগত ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। শিল্পকারখানার মালিকানার বেশির ভাগ জায়গা বরাদ্দ দেয়ার মতো বিতরণ করা হচ্ছে। গণমাধ্যম কম বেশি রাষ্ট্রপতি পুতিনের প্রশাসনই নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলো সমৃদ্ধ বটে কিন্তু কেন্দ্রে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত। গত বছরের অক্টোবরে রুশ ও বিদেশী বিশেষজ্ঞদের এক গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে পুতিনের এক উপদেষ্টা গর্ব করে বলেছিলেন, রুশরা অনুধাবন করেছে যে, যদি পুতিন না থাকে তাহলে রাশিয়া বলে কিছু থাকবে না। রুশ পণ্ডিত স্লানসিলাভ বেলকোভস্কি বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি যে জাতীয় নীতিমালার ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল তার কবর রচিত হয়েছে। এখন স্পষ্ট যে, রাশিয়ার জাতীয় নীতি হলো ভøাদিমির ভøাদিমিরোভিচ পুতিন।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, রাশিয়া এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই ভালো অবস্থায় রয়েছে। বেকারত্ব হ্রাস, গড় আয় বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের বিলাসী জীবন, ইউরোপের কোনো কোনো দেশের তুলনায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধি উন্নত রাশিয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু অর্থনৈতিক বন্ধ্যত্ব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সমাজের শ্লথগতি এবং দম্ভ করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। উল্লিখিত সেক্টরগুলো যারপরনাই দুর্নীতিগ্রস্তও হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রের অনুরূপ এ অব্যবস্থা রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেশব্যাপী বড় বড় পদকর্মকর্তারা মোটা টাকার বিনিময়ে কিনে নিচ্ছেন। এই ক্রেতারা সঙ্ঘবদ্ধ ক্রাইম সিন্ডিকেট গঠন যেমন করছেন তেমনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সরকারি উকিল ও বিচারকদেরও দলে ভিড়িয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন স্থিতিশীলতার যে জিকির তুলছেন তা এ ক্ষেত্রে অসার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অবশ্য ১৫ বছর ধরে পুতিন ক্ষমতায় আছেন। পুতিনের যে ক্ষমতার কোনো দিন অবসান ঘটবে এমনটি কিছু মনে হচ্ছে না। স্টালিন তিন দশক রাশিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন। ব্রেজনেভ ছিলেন দুই যুগ। সে তুলনায় পুতিন তরুণ এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পুরনো স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তিনি নতুন কনের সন্ধান করছেন।
পুতিন প্রশাসনের সর্বত্র তার লোক বসিয়েছেন। কেজিবির সাবেক প্রধান হিসেবে এসব তার নখদর্পণে। তিনি যদি তার ওই দুই পূর্ব সুরি থেকেও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও সেই স্বপ্ন রুশদের কাছে অধরাই রয়ে যেতে পারে। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে রাশিয়ায় এখন চলছে পুতিনের স্বৈরাচারী শাসন- যা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার ধারে কাছেও নেই। আজ রাশিয়ার সামনে একক কোনো আদর্শও নেই; নেই কোনো সুশৃঙ্খল ক্ষমতাসীন দল। আইনের শাসনেরও বিন্দুমাত্র বিধিব্যবস্থা অনুপস্থিত। আজকের রাশিয়ায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের যেমন অধিকার বিদ্যমান তেমনি সীমান্ত পারাপারেও অবাধ সুযোগ রয়েছে।
যে প্রক্রিয়ায় পুতিন একের পর এক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের সৃষ্টি ও উৎসাহিত করে চলেছেন, অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর যে স্বপ্নের রাশিয়া গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকে পরিণত হলেন, পুতিনকে তার খেসারত কম দিতে হচ্ছে না। জনসমক্ষে পুতিন নিজেই বলেছেন, তিনি যে আদেশ নির্দেশ দেন তার কুড়ি ভাগও বাস্তবায়িত হয় না। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি শক্তি প্রয়োগ করেন স্বার্থান্বেষী মহল তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুতিনের পক্ষে এত বস, গভর্নর এবং কর্মকর্তাদের জনে জনে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। আবার অনেকে পুতিনের নাম ভাঙিয়ে কার্যসিদ্ধি করে থাকেন। ব্যক্তি শাসনের সুফল হলো প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি কৌশলগত সংস্থা যেমন সিক্রেট পুলিশ কিংবা ক্যাম স্লো নিয়ন্ত্রণকারীদের নজরে রাখা। কিন্তু ওই সংস্থাগুলো স্বচ্ছতা আনয়নের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
পুতিনের জন্ম লেলিনগ্রাদে ১৯৫২ সালের ৯ অক্টোবর। তার কোনো ভাইবোনও নেই। পিটার দ্য গ্রেটের দুর্ধর্ষ অঞ্চলে তিনি বেড়ে উঠেছেন। মার্শাল আর্টে দক্ষ পুতিন লেলিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়ে প্রায় ভিক্ষা করার মতো কেজিবির একটি চাকরি নিয়ে ১৯৮৫ সালে পূর্ব জার্মানিতে পোস্টিং নেন। ১৯৯০ সালে বার্লিন ওয়ালের বিলুপ্তিতে পুতিনকে দেশে ডেকে পাঠানো হয়। এখানে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আনাতোলি শোবচাকের মাধ্যমে ভাগ্য ফেরাতে সক্ষম হন। শোবচাক প্রথমে সিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং পরে মেয়র হন। পুতিন তার শীর্ষ ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ পান। পুতিন লেলিনগ্রাদে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরানোর পাশাপাশি নিজে যেমন প্রচুর অর্থ সঞ্চয়ের সুযোগ পান তেমনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ভাগ্য গড়ে দিতে এগিয়ে আসেন। এভাবে তিনি গোপনে গোপনে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ সালে শোবচাক পুনর্নির্বাচনে হেরে গেলে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে পুতিন বেকার হয়ে পড়েন। কিন্তু এক বছরের মাথায় রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ আলেক্সি কুরভিনের মাধ্যমে মস্কোতে রাষ্ট্রপতির অফিসে বড় বড় কাজের দায়িত্ব পান পুতিন। আলেক্সিও শেবচকের একসময়ের সহকারী ছিলেন। ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন সাবেক লে. কর্নেল পুতিনকে গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি পরে কেজিবির প্রধান করেন। এর কিছু দিনের মধ্যে পুতিন রাশিয়ার প্রথম ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। পুতিনের এ ক্ষমতা আরোহণের জয়যাত্রায় তিনি কোনো পর্যায়েই জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি সব পর্যায়েই সিলেকটেড হয়েছেন।
ইয়েলৎসিন পরিবারে অন্তর্ভুক্তির সুযোগে পুতিনের ভাগ্য আরো খুলে যায়। ইয়েলৎসিনের নিজস্ব একটি গণ্ডি ছিল। ইয়েলৎসিনের আত্মজীবনীর ঘোস্ট রাইটার ভ্যালেন্টিন ইউমালেভ এবং তার হবু স্ত্রী ও ইয়েলৎসিনের মেয়ে তাতিয়ানা অনেকের মধ্য থেকে পুতিনকে তাদের পরিবারের একজন করে নেন। প্রশাসনে দক্ষ এবং ওই পরিবারের বশ্যতা স্বীকারে পারঙ্গম এর যোগ্যতা বলে পুতিন কাজ পেয়ে যান। তার প্রধান কাজ হলো সব ক্ষেত্রে ইয়েলৎসিন পরিবার এবং একই সাথে রাশিয়ার স্বার্থ দেখভাল করা। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাশিয়ার প্রধান টিভি চ্যানেল ওয়ানের নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করে পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রাপ্ত ভোটের শতকরা ৫৩ ভাগ ভোট অর্থাৎ চার কোটি ভোট পান পুতিন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী পান ২৯ শতাংশ ভোট।
মজার কথা হলো, পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও বছর দুই মূল ক্ষমতা ছিল তার চিফ অব স্টাফ আলেকজান্ডার ভালাসিনের হাতে। কেননা ভালাসিন পুতিনের চেয়েও ইয়েলৎসিনের পরিবারের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। তরুণ ভালাসিন ও তার বন্ধুরা সব ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি করেন। রাশিয়ার তখন ছিল ৮৯টি অঞ্চল। এসব অঞ্চলের প্রধান গভর্নরদের কারো কাছেই কোনো জবাবদিহিতা করতে হতো না। এ অরাজক অবস্থায় পুতিন বুদ্ধিবলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নিতে সক্ষম হন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ও লোকদেখানো তৎপরতা চালান। টিভি সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ নেন; নিয়ন্ত্রণ নেন তেল ও গ্যাস কোম্পানির। গ্রেফতার করেন বহু নাটের গুরুকে। তাদের মধ্যে একজন হলেন ভালাসিনের অনুগামী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মিখাইল খোদরকভিস্কিকে। তার প্রাইভেট বিমান ছিল। এ বিমানের ছবি পুতিনের নিয়ন্ত্রণাধীন টিভিতে হাজারবার প্রদর্শিত হয়। রুশ নাগরিকেরা বলে উঠতে থাকেন পুতিন রাশিয়াকে রক্ষা করলেন। এ সময় অর্থনৈতিক অবস্থা হঠাৎ করে ভালো হয়ে ওঠে। এ সময় রাশিয়ায় কৃষ্ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ ঘটে। প্রচুর বেড়ানো এবং মার্কেটিং করার সুযোগ সৃষ্টি হয় তাদের। রাশিয়ায় মোবাইল ফোনের হার শূন্য থেকে শতকরা একশত ভাগে উন্নীত হয়। অনেক বিশ্লেষক এসব ক্ষেত্রের এই উন্নয়নকে শুভ লক্ষণ বলে অভিহিত করেন। কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যদিও পুতিন বিরোধীরা এসব উন্নয়নের জন্য পুতিনকে কোনো কৃতিত্ব দিতে চাইছিলেন না।
রুশ আমেরিকান সাংবাদিক মাশা জেসেন ১৯১২ সালে পুতিনের আত্মজীবনী লেখেন। এ জীবনীর সার কথা হলো পুতিন রাশিয়ার জন্য একটা এক্সিডেন্ট। মাশা জেসেন পুতিনকে একজন মার্ডারার কিন্তু আলটিমেটলি একজন স্মল ম্যান হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু এ কথাও সত্য এক্সিডেন্টের কারণে কোনো লোক এত দিন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে রাখতে সমর্থ মনে করা সঙ্গত নয়। পুতিন সম্পর্কে আরেকটি বই লিখেছেন রাশিয়ারই ফিয়োনা হিল ও ক্লিফোর্ড গ্যাডি। এ বইয়ে তারা পুতিনকে ফ্রি মার্কেটিয়ার, কেস অফিসার এ রকম ছয়টি অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। বইয়ে তারা লিখেছেন যে, পুতিন একজন মস্কোবাসী নন, কেজিবির মূল ধারার লোকও নন। আবার কেস অফিসার বলতে গিয়ে বলেছেন, ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে পুতিন মানুষের মন জয়ে দক্ষ, ব্ল্যাকমেইল এবং ঘুষ প্রদানেও দক্ষ।
ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে জারিকৃত পশ্চিমাদের অবরোধ শুধু রাশিয়ার বিরুদ্ধে নয়, পুতিনের দুষ্কর্মের সাথীদেরও ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। কারণ দাওইশা বলেছেন, গ্যাস পাইপলাইন, কনস্ট্রাকশন ফার্ম, গানভর গ্রুপ, গ্যানপ্রমের মালিকসহ বহু কোম্পানির মালিকেরা এ অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ এসবের মালিকদের অনেকেই পুতিনের সেন্ট পিটার্সবার্গ আমলের বন্ধু। পুতিনের সাথে এরা সিন্ডিকেট গড়েছিলেন বহু আগে। দাওইশা পুতিনের জীবন কাহিনী লিখতে গিয়ে বলেছেন, পুতিনের ওইসব বন্ধু কিন্তু বনেদি ধনী নয়। তাদের উত্থানপর্ব শুরু হয় ১৫-১৬ বছর আগে থেকে। আসলে পুতিনের সাহায্য নিয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ সরকারি ঠিকাদারি, রহস্যজনক ব্যাংক ঋণ গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে তারা বড় লোক হয়েছেন। দাওইশা লিখেছেন, তিনি পুতিনের হাতে জনসমক্ষে সাত লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের ঘড়ি দেখেছেন। দাওইশার হিসাব অনুযায়ী পুতিনের সম্পদের মূল্য ৪০ বিলিয়ন ডলার।
পুতিনের ওপর লিখিত বেশির ভাগ গ্রন্থই তার প্রথম দফার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময়কালকে নিয়ে। কিন্তু দাওইশা লিখেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর কেজিবি ব্যক্তি খাতে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করেছিল। এর মূল হোতা হলেন পুতিন। পুতিন তার সিন্ডিকেট নিয়ে সেই সামান্য ক্ষমতার আমলেই বেসরকারি খাতে ব্যবসাবাণিজ্যের বীজ রোপণ করেছিলেন। পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে দুই বছরের মাথায় যখন সত্যিকারভাবে ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠেন তখন খোদরকভস্কিসহ যেসব ব্যবসায়ীকে ব্যাপক ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তার মূলেও কিন্তু পুতিনের সেন্ট পিটার্সবার্গ কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট দায়ী। দাওইশা আরো লিখেছেন, অপরিণত গণতন্ত্রকে সত্যিকার ভিতের ওপর দাঁড় করানোর কোনো বাসনা পুতিনদের ছিল না। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই পুতিনের সিন্ডিকেট গণতন্ত্রকে ডেকোরেশন হিসেবে বিবেচনা করেছেন- ডাইরেকশন হিসেবে নয়। দাওইশা কেজিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, পুতিনকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ইতিহাস। পরাশক্তি রাশিয়াকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এবং বিশ্বকে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য ইতিহাস পুতিনকে বিশেষ অপারেশনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে। দাওইশা মেদভেদভকে টেডি বিয়ার অভিহিত করে বলেছেন, তাকে বিশেষ প্রয়োজনে পুতিন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার অনেক বন্ধু ও সহচর প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে বরখাস্ত করার বহু অনুরোধ-উপরোধ করেছেন বটে তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ পুতিনকে বরখাস্ত করার যথেষ্ট ক্ষমতা মেদভেদেভের হাতে ছিল। কিন্তু রুশ জনগণ এবং পশ্চিমা বিশ্বকে মেদভেদেভকে দেখিয়ে বছরের পর বছর বোকা বানিয়ে চলেছেন পুতিন।
বিশাল দেশ রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলে পুতিনের ওপর বই লিখেছেন সাংবাদিক বেন জুডাহ। তার মতে ভঙ্গুর সাম্রাজ্য রাশিয়ায় তৃতীয়বারের মতো পুতিনের প্রেসিডেন্ট হওয়াটা দেশের জনগণের ওপর একটা চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। সেন্ট পিটার্সবার্গ সিটি অ্যাসেম্বলির সাবেক প্রধান আলেকজান্ডার বেলায়েৎ বলেছেন, বন্ধু বানাতে পুতিন বিশেষভাবে দক্ষ। একই সাথে বন্ধুদের প্রতি পুতিন খুবই লয়্যাল। মানুষের স্বভাব চরিত্র বুঝতে তার মতো মেধাবী লোক বিশ্বজুড়ে খুব কমই আছে। আর ট্যাকটিস ও কার্যোদ্ধারেও তার জুড়ি নেই।
পুতিনের সেন্ট পিটার্সবার্গ কেন্দ্রিক বন্ধু যিনি একটি প্রাসাদ কিনতে পুতিনকে অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন; সেই সের্গেই কোলেসনিকভকে একটি দুর্নীতি মামলায় এস্তোনিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। সের্গেই সাংবাদিক বেন জুডাহকে বলেছেন, পুতিন পুনর্বার প্রেসিডেন্ট হওয়ায় আমি বিস্মিত। প্রথম দিকে আমি আমার সাধ্যমতো পুতিনকে সহযোগিতা করছিলাম বটে। আসলে ১৯৯০ সাল থেকে দুষ্টচক্র ক্ষমতা দখল করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মাধ্যমে আমি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিলাম। অথচ দেখতে পাচ্ছি, রাশিয়াজুড়ে এক ব্যক্তির স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে।
জুডাহ তার দুইটি বইয়ের একটিতে আরো লিখেছেন যে, প্রোপাগান্ডা যে সব সময় ভালো ফল দেয় তা নয়। তাহলে নিরাপত্তা খাতে পুতিনকে ব্যয় এত বেশি বৃদ্ধি করতে হতো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে ২০০০ সালে ব্যয় হয়েছিল দুই দশমিক আট বিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারে। নতুন মধ্যবিত্তের ৪০ শতাংশ রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে। কিন্তু তারা স্বাধীন জনগণ নয়। সাংবাদিক জুডাহ লিখেছেন, মস্কো নিজ ভূখণ্ডেই নির্যাতক কলোনিয়াল শাসন চালাচ্ছে।
জুডাহ ঘুরতে ঘুরতে রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল যা এক সময় মঙ্গোলিয়ার অর্ন্তগত ছিল সেই টুডায় যান। সেখানে শিকারের আয়োজনে পুতিন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সেখানকার এক গ্রামবাসী বলেন, পুতিন? সে কখনোই দেশের জন্য ভালো কিছু করেনি। সে তেল ও গ্যাসক্ষেত্র থেকে শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়েছে। তার বন্ধুদের ধনী বানিয়েছে। আমরা কেন পুতিনকে সমর্থন করে যাবো। জুডাহ ইহুদিদের হোমল্যান্ড বলে পরিচিত চীন সন্নিহিত বিরোবিদখান নামের একটি এলাকায় যান। সেখানে তিনি রাশিয়ার গ্রামেই শত শত চীনা নাগরিককে দেখতে পান। সেখানে তিনি এক মাশরুম চাষির কাছে জানতে চান এ ভূমি কি রাশিয়ার দখলে থাকবে না চীনাদের অধীনে চলে যাবে। এ মাশরুম চাষিই আসলে চীনা নাগরিক। চাষিটি জুডাহকে যে উত্তর দেন তাকে গালাগাল বললেও কম বলা হবে এবং তার বলার ভঙ্গিটি ছিল এমন যে, এটি আসলে চীনেরই ভূমি। জুডাহ লিখেছেন, রাশিয়ার বহু স্থানেই পুতিন অপরিচিত এবং বহু এলাকাই ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে। আসলে ইতিহাস যে কখনো কখনো নেতা বানিয়ে ফেলে পুতিন তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাকে তুচ্ছ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা না করে দুর্যোগ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত বলে অনেকের অভিমত।
এক যুগ আগে সুইডেনের উপশালা বিশ্ববিদ্যালয়ের রুশবিষয়ক গবেষক স্টেফান হুডল্যান্ড দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ব শ্লাভিক ইতিহাস নিয়ে একটি সমৃদ্ধ প্রবন্ধ লেখেন। পুতিনের প্রায় স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, রাশিয়া ১৬১০-১৩, ১৯১৭-১৮ এবং ১৯৯১ সালে কলাপস করেছিল। হুন্ডল্যান্ড উল্লেখ করেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাশিয়ার কোনো সাফল্য নেই। যদিও রাশিয়া সব সময় পরাশক্তি হতে চেয়েছে। ১৯৯৯ সালে পুতিন অনলাইনে তার যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন সেখানে তিনি স্পষ্টতই বলেন যে, গত দুই থেকে তিন শত বছরের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। রাশিয়ার জন্য এটা একটা দুঃসময়। পুতিন রাশিয়াকে বিশ্বের সেরা হিসেবে পরিগণিত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। তবে অনেক সাফল্যের মধ্যে একটি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ের চেয়ে বর্তমান রাশিয়ায় গোত্র ও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি জাতীয়তাবাদী চেতনারও উন্মেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রেমলিন বিশ্বাস করে আমেরিকা বিশ্বব্যবস্থায় অস্থিরতা আনয়নকারী। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাশিয়া ভারসাম্য যেমন বজায় রাখছে তেমনি পরাশক্তি হিসেবে ভিকটিম দেশকে যথাসম্ভব সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
লিলিয়া সেকটসোভা নামের এক বিশ্লেষকের মতে, রাশিয়া হলো ‘লোনলি পাওয়ার।’ তার মতে পুতিনের রাজনীতি হলো লুণ্ঠনপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে দুই স্থানেই তার একই আচরণ। ইউরোপের সন্ত্রাসবাদীদের সাথে তার যেমন অন্তরঙ্গতা বিদ্যমান তেমনি শক্তিশালী চীনের সাথে ভাব বজায় রাখাটাকেও রাশিয়ার বড় ধরনের কৌশল বলে মনে করেন পুতিন। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার কোনো মিত্র নেই এবং সব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুতিন নষ্ট করে ফেলেছেন। যেমন পশ্চিম জার্মানির সাথে একসময়কার মধুর সম্পর্ক আজ আর নেই। তার মতে, জাতীয়তাবাদ ও রক্ষণশীল মনোভাব সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরও অক্ষুণœ ছিল। কিন্তু ২০১২ সালের পর রাশিয়ায় এ স্লোগান আরো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। এর কারণ হলো পুতিন পুনর্বার প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে ২০১১-১২ সালে লোকজন প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এ দিকে ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া নিয়ে পুতিন বিশ্ববাসীকে যা দেখাতে চাইলেন তা হলো, রাশিয়াকে গ্রেট পাওয়ার হিসেবেই গণ্য করতে হবে। যদিও জুডাহ লিখেছেন, পুতিনের শাসনামলের যবনিকাপাত ঘটার আর খুব বেশ দেরি নেই। গবেষকদের এ পর্যায়ে উপসংহার হলো, রুশ নেতা নিজেকেই নিজের জালে যেমন আবদ্ধ করে ফেলেছেন তেমনি বরফে ঢাকা সমস্যাগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে বৈকি! পুতিন কিংবা তার পশ্চিমা প্রতিপক্ষ কোনোক্রমেই ইউক্রেন নিয়ে বিরোধ দীর্ঘকাল জিইয়ে রাখবে না। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের সমর্থন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং রুশ সমর্থিতদের দ্বারা একটি বেসামরিক বিমান ধ্বংস পশ্চিমাদের অবরোধ জারিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু সমস্যাটা শুধু রাশিয়ার আগ্রাসন কিংবা রাশিয়াকে ওই অঞ্চল থেকে উৎখাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যদি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাশিয়াকে ওই এলাকা থেকে উৎখাত করাও হয় তা দীর্ঘ দিন কার্যকরও রাখা যাবে না।
দীর্ঘ সময় ধরে ইউক্রেনকে দুর্বল থেকে দুর্বল করেছে রাশিয়া। দুই দশকের অপশাসন তো ছিলই। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে, এই স্বাধীন দেশটি এতই বিশাল যে, রাশিয়ার পক্ষে তা গ্রাস করা বা গিলে ফেলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের সীমানা বিন্যাস ও একীভূতকরণ শুরু হয়। যেমন হংকং এবং মেকাও শান্তিপূর্ণভাবে চীনের সাথে চলে গেছে। যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধ ও সহিংসতা শেষে ভেঙে গেছে। অভ্যুদয় হয়েছে কসোভোর। আজারবাইজানের নগোর্নো-কারাবাস, মনটোভার ট্রান্সনিসাট্রিয়া, জর্জিয়ার আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়া তাদের অবস্থান বদল করেছে। দোনেস ও লুথান্সকও ইউক্রেনের অংশ। লক্ষ্যযোগ্য দিক হলো স্টালিনের সীমান্ত নির্মাণের সাথে ওই স্থানগুলোর সম্পর্ক বিদ্যমান।
যা হোক, ইউক্রেনের যে সমস্যা তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। এমনকি জাতিসঙ্ঘও পারবে না। আমেরিকাও ইউক্রেনকে ঘিরে যুদ্ধ শুরু কিংবা রাশিয়ায় বোমা ফেলতে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমেরিকা ইউক্রেনে নতুন করে সীমান্ত তৈরির সমঝোতার পথে এগোবে। কিন্তু বৃহৎ শক্তির দম্ভের কারণে সমঝোতার পথে রাশিয়াকে কতটা মানানো যাবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আর পুতিনের জীবদ্দশায় কোন বিরোধের কী ধরনের পরিণতি হবে তা বলাও মুশকিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনকে এভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যেমন থাকতে হবে এবং ইউরোপের অর্থনীতিও তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে। সবচে বড় কথা পুতিনের রাশিয়াকে হ্যান্ডেল করা দিনকে দিন কঠিনতর হয়ে উঠবে। তবে রুশ নেতাদের বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা বলাই বাহুল্য। পুতিন নিশ্চয়ই সে ব্যাপারটি স্মরণে রাখবেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
Kaikobadmilan1955@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.