কেন আসাদকে সরাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র?

মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র। বর্তমানে ওই অঞ্চলের জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও সিরিয়া যুদ্ধ বিশ্ববাসীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। দৃশ্যত ইরাক-সিরিয়ার আইএস দমনে যুদ্ধ করে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠায় সিরিয়ার ‘একনায়কতান্ত্রিক’ প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন চেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে ইতিহাস বলে, আসাদ সরকার দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রেরও সমর্থন পেয়ে আসছিল। যেমন পেয়েছিলেন লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি। গাদ্দাফির প্রয়োজন ফুরানোর মতো অর্থহীন হয়ে উঠেছে আসাদ সরকার। এ লক্ষ্যে সিরিয়ার আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের অস্ত্র জোগান ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলমান রাখা হয়েছে। গত চার বছরের এ সংঘাতে নিহত হয়েছে অন্তত দু’লাখ মানুষ। উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ১০ লাখ। ওবামার যুক্তি, সিরিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং আইএস নির্মূল করতে স্বৈরশাসক আসাদের সরে দাঁড়াতে হবে। এতে শেষ হবে গৃহযুদ্ধও। কিন্তু আসাদের সমর্থনে রাশিয়ার বিমান হামলা শুরুর পর পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আসাদকে সরাতে চাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য কী? সৌদি আরব, ইয়েমেন, বাহরাইনে কেন একনায়কতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে না?
ইরান-আসাদ-হিজবুল্লাহ : অলংঘনীয় শিয়া জোট : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে দমিয়ে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশকের পররাষ্ট্রনীতি। শিয়া অধ্যুষিত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় থেকেই সর্বাÍক সমর্থনে পাশে রয়েছে সিরিয়া। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পর সৃষ্ট মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতোই সিরিয়া একটি নতুন সীমানা নিয়ে প্রতিষ্ঠা পায়। সত্তরের দশক থেকেই সিরিয়ায় শাসন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করছে শিয়া আদর্শিত আসাদ পরিবার। বাশার আল আসাদের বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদও ইরানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদিকে লেবাননের ইসলামি গ্র“প হিজবুল্লাহর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে সিরিয়া ও ইরানের। ইসরাইলবিরোধী হিজবুল্লাহ অধিকাংশ বিশ্বশক্তির কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব সুন্নি দেশ হওয়ায় ইরান-সিরিয়ার শিয়া সরকারের বিরোধী। আসাদ সরকারের পতন হলে ইসরাইল ও সৌদি আরব লাভবান হবে।
আসাদের ইসরাইলবিরোধী কঠোর অবস্থান : ২০০৯ সালে বাশার আল আসাদ এক বক্তব্যে বলেন, অবৈধ দখলদারিত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে? যতক্ষণ না ইসরাইল ফিলিস্তিনের দখলকৃত সব জমি ফেরত দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আরব জাতিরা, বিশেষ করে সিরিয়া, ইসরাইলকে সমর্থন করব না। এ ছাড়া ২০০৩ সালের এক নথি অনুযায়ী, ইরাক-সিরিয়ার মধ্য দিয়ে ইসরাইলের একটি তেল পাইপলাইন প্রতিষ্ঠার জন্য এখানকার সরকার পরিবর্তন জরুরি।
রাশিয়া-চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক : আসাদ পরিবার সোভিয়েত আমল থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। আসাদ পরিবারের ৪০ বছরের শাসনামলে সব সময়ের সঙ্গী রুশ নেতারা। ১৯৬৭ সালের সিরিয়া-ইসরাইল যুদ্ধে দামেস্ককে সামরিক পরামর্শ ও সহায়তা দিয়েছিল মস্কো। প্রতিদানে সিরিয়ার নৌঘাঁটির সহায়তা পেয়েছে রাশিয়া। লাটাকিয়ার দক্ষিণে তারতুস বন্দর ব্যবহার করে মস্কো। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার আর কোনো বন্দর সুবিধা নেই। পোলান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েনকৃত ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলায় ২০০৮ সালে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের সুযোগ পেয়েছিল রাশিয়া। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সিরিয়ার এক নম্বর বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বেইজিং থেকে দামেস্কে আমদানির পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি ডলার।
তেলপ্রাপ্তি ও অস্ত্র ব্যবসার নতুন বাজার : সিরিয়ার তেলসম্পদ দীর্ঘদিন নজরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন অনুগত সরকার হলে সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ ছাড়া সিরিয়া তার যুদ্ধাস্ত্রের অধিকাংশই কিনে থাকে রাশিয়া থেকে। অথচ বিশ্বের শীর্ষ ১০০ অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৪৪টি যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অস্ত্র ক্রেতা ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও লিবিয়া। তবে গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার বাজার এখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। আসাদের পতন হলে আরেকটি অস্ত্রবাজার পাবে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে আসাদ : সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়েছে। এটা ওয়াশিংটনের জন্য অস্বস্তিকর।

No comments

Powered by Blogger.