নগরবাসীকে জাগিয়ে ঘুমাচ্ছে সিটি করপোরেশন- জরাজীর্ণ দশা রাস্তাঘাটের by খালিদ সাইফুল্লাহ

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় রাস্তার বেহাল দশা। গত রোববার
রাস্তার ওপর এভাবেই উল্টে পড়ে একটি ট্রাক : নয়া দিগন্ত
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আলস্য যেন কাটছেই না। রাজধানীর সড়কগুলোর ভগ্নদশা দিন দিন বেড়ে চললেও এগুলোর উন্নয়নে তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। নামকাওয়াস্তে পুটিং করেই দায়িত্ব শেষ তাদের। আর ভোগান্তি প্রতিনিয়ত পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ নিয়ে বাসিন্দাদের ঘুম হারাম। তাদের মতে, মানুষকে জাগিয়ে ঘুমাচ্ছে সিটি করপোরেশন। এ বছর রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। বর্ষা মওসুম শেষ করে ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও অঝোরধারার বৃষ্টিপাত নগরবাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে। ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতিটি সড়কে হাঁটুপানি জমে দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এখনো অনেক এলাকায় তা বিদ্যমান। এ কারণে এখন রাজধানীর বেশির ভাগ রাস্তারই পিচ উঠে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত হয়ে গেছে। অনেক স্থানে সড়ক দেবে গিয়ে বড় গর্ত হয়েছে। মূল সড়ক থেকে অলি-গলি সর্বত্রই একই অবস্থা। দুই সিটি করপোরেশন মাস দেড়েক আগে এক দফা ইট-বালু দিয়ে গর্ত সমান করার চেষ্টা করলেও আবার ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় সড়কগুলো আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। সম্প্রতি আরো এক দফা দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে রাস্তাগুলোর করুণ দশা হয়েছে। মেয়ররা সড়ক উন্নয়নে সরকারের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পেলেও এখনো পর্যন্ত কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী মাস নাগাদ টেন্ডারপ্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এরপর প্রক্রিয়া শেষ করে চূড়ান্তভাবে কাজ শুরু হতে আগামী বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। শেষ করতে আরো আরো ছয় মাস। সে পর্যন্ত নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতেই হবে।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে রাস্তা রয়েছে প্রায় দুই হাজার ১১৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে আছে এক হাজার ৩৩৮ কিলোমিটার এবং দেিণ ৭৮১ কিলোমিটার। ঢাকায় বড় বড় যানবাহন চলাচল করতে পারে এমন প্রধান সড়ক (প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও সংযোগ) রয়েছে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা দেিণর বড় সড়ক ১৫৮ কিলোমিটার। বাকি প্রায় এক হাজার কিলোমিটার রাস্তা সঙ্কীর্ণ ও গলি। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার দুই হাজার ১১৯ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে বর্তমানে হাজার কিলোমিটারের ওপর রাস্তা কম-বেশি খারাপ রয়েছে। তবে গত দেড় মাস আগে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক জরিপের মাধ্যমে ১৬৫ কিলোমিটার ভাঙাচোরা সড়কের তালিকা তৈরি করেছে। একইভাবে উত্তর সিটি করপোরেশনও তাদের খারাপ সড়কের তালিকা প্রস্তুত করেছে। তাদের মোট সড়কের প্রায় অর্ধেকই ভাঙা বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোড় দীর্ঘ দিন থেকেই যানজটের জন্য খ্যাত ছিল। এটি থেকে মুক্তি দিতে তৈরি করা হয় মেয়র হানিফ ফাইওভার। এতে খানিকটা স্বস্তি ফিরেছে। অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ফাইওভারের ওপর দিয়ে যারা চলাচল করছেন তারা কিছুটা মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু ফাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করা যানবাহন ও পথচারীদের চরম বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। নিচে গাড়ি চলাচলের জন্য কয়েকটি সরু লেন তৈরি করা হয়েছে। এগুলোই এখন মারণফাঁদে পরিণত হয়েছে। ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে প্রতিটি লেন। বড় বড় গর্তের কারণে এখানে প্রায়ই গণপরিবহন দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। এ ছাড়া কাদাপানির কারণে পথচারীরাও চলাচল করতে পারছেন না।
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান পল্টন মোড় ঘেঁষে সরকারের মূল কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় অবস্থিত। এ সচিবালয়ে বসেই মন্ত্রীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু এ সচিবালয়ের পাশ ঘিরে পল্টন মোড় থেকে প্রেস কাব, জিরো পয়েন্ট রোড, দৈনিক বাংলা সড়ক ও বিজয়নগর সড়কের প্রতিটির অবস্থায়ই এখন শোচনীয়। পল্টন মোড়ের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়ে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। মাসখানেক আগে এসব গর্ত ইট-বালু দিয়ে ভরাট করা হলেও ক’দিন না যেতেই আবার একই রূপ ধারণ করেছে। এখান দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে গণপরিবহন ও পথচারীরা সমস্যায় পড়ছেন।
মেরুল বাড্ডা কাঁচাবাজারের সামনে সড়কটিতে বেশ কিছু দিন ধরে পানি জমে রয়েছে। এ কারণে সড়কও ভেঙেচুরে গেছে। মধ্য বাড্ডায় ফুটওভার ব্রিজের নিচে পানি জমে আছে। ড্রেন বন্ধ থাকায় কিছুতেই তা সরছে না। বাড্ডা লিংক রোডের গুদারাঘাট এলাকায় মূল সড়ক ও আশপাশের বৈশাখী সরণি, গোল্ডেন প্লাজার সামনে এক সপ্তাহ ধরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বৃষ্টির পানির সাথে স্যুয়ারেজের পানি মিশে এলাকার পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ে। গতকাল পানি অপসারণ করা হয়েছে। তবে এখনো কাদাপানি রয়েছেই। এ কারণে রাস্তাটির অবস্থাও করুণ। বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় কাঠের একটি ভাঙা টুল দিয়ে পরিবহনগুলোকে সতর্ক করা হচ্ছে। গুলশান-২ মোড়সহ আশপাশের অনেক সড়ক ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে।
মূল সড়কের চেয়ে অলিগলির অবস্থা আরো খারাপ। মতিঝিল মোড়ের অদূরে কবি জসীমউদ্দীন সড়ক। এখানকার প্রতিটি অলিগলিতে অসংখ্য গর্ত। অনেক স্থানে রাস্তা দেবে গিয়ে বড় গর্ত হয়ে গেছে। ফলে প্রাইভেট কার ও রিকশাকে অত্যন্ত সতর্কভাবে চলাচল করতে হচ্ছে। খিলগাঁও, বাসাবো, সবুজবাগ, মানিকতলা, মুগদাসহ ওই এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে।
ফাইওভার নির্মাণের কারণে রাজারবাগ, মালিবাগ, মৌচাক থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়কে অসংখ্য বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। এক দিকে ফাইওভার নির্মাণজনিত সমস্যা, তার ওপর ভাঙাচোরা সড়কে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। মৌচাক থেকে মগবাজার ওয়্যারলেস রেলগেট সড়কেরও বেহাল দশা। মালিবাগ মোড় থেকে রাজারবাগ মোড় পর্যন্তও একই অবস্থা। পুরো সড়কটিই চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপোযোগী।
মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় থেকে মধুবাগ সড়কটির অবস্থা খুবই করুণ। ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত তৈরি হওয়ায় সড়কটি দিয়ে যান ও জন চলাচলে মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। প্রায়ই দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছেন যাত্রীরা।
রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। রিকশা থেকে বাস সব ধরনের গাড়িই এর শিকার। গুলশান থেকে মতিঝিল চলাচলকারী ৬ নম্বর বাসের চালক অহিদুল জানান, ভাঙা রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে গাড়ির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। টায়ার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্রত। পাতি ভেঙে যাচ্ছে। এতে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গাজীপুর-মতিঝিল-সায়েদাবাদ রুটে চলাচলকারী ছালছাবিল পরিবহনের চালক মো: সাগর তীব্র ক্ষােভ প্রকাশ করে বলেন, হয় যানজট না হলে রাস্তা খারাপ। একটা না একটা সমস্যা লেগেই থাকে। গাড়ি চালাতে গিয়ে মনমেজাজ ভালো থাকে না। যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী ৮ নম্বর গাড়ির চালক আনিছুর রহমান বলেন, খানাখন্দ ছাড়াও রাস্তার ওপর পড়ে থাকা ইট-পাথরের সুরকির ওপর দিয়ে গাড়ি চালালে টায়ারের বারোটা বেজে যায়। নতুন টায়ারগুলো পাথরের খোয়ায় লেগে কেটে যায়। আর একটা টায়ার নষ্ট হলেই ২০-৩০ হাজার টাকা গচ্চা।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্প্রতি তাদের ১৬৫ কিলোমিটার ভাঙাচোরা রাস্তার তালিকা তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি ড্রেন নির্মাণ, নর্দমার উন্নয়নসহ সংশ্লিষ্ট খাতে ‘কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট অব রোড অ্যান্ড আদার ইনফ্রাস্টাকচার অব ফাইভ জোন আন্ডার ঢাকা সিটি করপোরেশন’ প্রকল্পের আওতায় সরকারের কাছ থেকে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো তৎপরতাই এখনো চোখে পড়েনি। ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী মাস থেকে টেন্ডারপ্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এরপর চূড়ান্তভাবে কাজ শেষ করতে আরো এক-দেড় মাস লেগে যাবে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে কাজ শুরু হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন এ ব্যাপারে গঠিত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান।
উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরই আনিসুল হককে একনেক থেকে ২০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। সড়ক, ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে এ টাকা ব্যয় করার কথা রয়েছে। তবে টাকা বরাদ্দ করা হলেও এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি ডিএনসিসি। মাস দেড়েক আগে ইট-বালু দিয়ে কোনো রকম ঠেকার কাজ চালিয়েছিল তারা। কিন্তু বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় রাস্তার সেসব ইট-বালু ধুয়ে এখন আগের থেকেও খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ জানিয়েছেন, এ বছর বেশি সময় ধরে বৃষ্টিপাত হওয়ায় রাস্তা বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে। এসব রাস্তার তালিকা আমাদের কাছে আছে। ছোটখাটো গর্তগুলো ইটের খোয়া দিয়ে আগে একবার ম্যাকাডাম করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মওসুম শুরু হওয়ায় আবার কাজ চলছে। এ জন্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে রাস্তার ছোটখাটো গর্ত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে পুরোদমে সব সড়কের কাজ শুরু করতে আরো সময় লাগবে। বর্তমানে কয়েকটি কাজের টেন্ডারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী মাসে টেন্ডারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ রাস্তা মেরামত শুরু হবে। জুন মাস নাগাদ সব রাস্তা মেরামত সম্পন্ন করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.