সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে নারী হুমকির মুখে ব্যক্তি গোপনীয়তা by আফরিন আপ্পি

দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মেয়ে রিতা (ছদ্মনাম)। ছয় বছর আগে তার সখ্য গড়ে উঠেছিল এক সহপাঠীর সঙ্গে। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। একদিন বাড়িতে মা-বাবা না থাকায় রিতা ছেলেটিকে আসতে বলে। ছেলেটি বাড়িতে এলে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর ওই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের কিছু ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে রাখে রিতার প্রেমিক। এরপর থেকে তারা সুযোগ পেলেই মিলিত হতো। এভাবে ৬ বছর তাদের ভালই কাটে। কিন্তু সমস্যার শুরু হয় তখনই যখন উভয়ের মাঝে মনোমালিন্য দেখা দেয়। একটা সময় পর রিতা তার প্রেমিককে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। মুক্ত হতে চাচ্ছিলেন পুরানো সম্পর্ক থেকে। কিন্তু রিতার প্রেমিক এতে কোনভাবেই রাজি নন। সে ব্যবহার করে সাইবার অস্ত্র। রিতাকে হুমকি দেয় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তোলা ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার। ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়েও দেয়। এ ব্যাপারে মেয়ের পিতা বাদী হয়ে গত ২১শে মে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন (মামলা নম্বর ২২)।
এভাবে প্রতিনিয়তই সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে পড়ে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে বহু নারীর জীবন। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউবের অপব্যবহারে হুমকির মুখে পড়েছে ব্যক্তির গোপনীয়তা। মানবজমিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন বেশ কিছু ঘটনা।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। ঘরে আড়াই বছর এবং ছয় বছর বয়সী ফুটফুটে দুটি সন্তান। তার স্বামী প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। চাকরি সূত্রে থাকেন ঢাকার বাইরে। স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে নিজের থেকে ১০-১১ বছরের ছোট এক ছেলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যান তিনি। ওই যুবকও বিবাহিত। ছয় বছর বয়সী এক সন্তানের জনক। কিন্তু তাদের এ অনৈতিক সম্পর্ক কোন বাধাই মানে না। নানাস্থানে একান্তে সময় কাটাতেন তারা। একবার ওই নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে অনেক দিন ঢাকায় থাকতে হয় তার স্বামীকে। একপর্যায়ে তিনি বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন স্ত্রীর অবৈধ প্রণয়নের কথা। দেখেন স্ত্রীর মোবাইল ফোনে ধারণ করা আছে ওই যুবকের সঙ্গে নানা অশ্লীল ছবি, এসএমএস। পাওয়া যায় কথোপকথনের রেকর্ডও। জানতে পারেন ওই যুবকের মোবাইল ফোনেও আছে একই ছবি, রেকর্ড। এরপর কর্মকর্তার পরিবার থেকে সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আটকের পর ওই যুবক পুলিশের কাছে বলেন, তার প্রেমিকা যাতে কখনও তাকে ছেড়ে যেতে না পারে এজন্য তিনি প্রমাণস্বরূপ এগুলো রেখে দিয়েছেন। পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখার এক কর্মকর্তা জানান, তাদের দীর্ঘ ফোনালাপ যদি কেউ বিরতিহীনভাবে শোনে তাহলে তার সময় লাগবে মোট ৪৮ দিন।
এমনই এক সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন একজন সাংবাদিক। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ওই সাংবাদিকের ফোনে নানারকম হুমকি আসতে শুরু করে। ফোন করে তার স্ত্রীর নামে বলা হতে থাকে অশ্রাব্য কথা। এসবকিছুর পরও  সহনশীলতার মাত্রা  ছাড়িয়ে যায় তখনই যখন তার স্ত্রীর নামে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে সেখানে তার স্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে নানারকম খারাপ ছবি ও অশালীন মন্তব্য পোস্ট করা হয়। এর ফলে সাংবাদিক দম্পতি সমাজে মারাত্মকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হন। এ ব্যাপারে ওই সাংবাদিক মামলা  করেন। বর্তমানে অপরাধী শনাক্তের প্রক্রিয়া চলছে। এমন সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা অনেকে হারিয়ে ফেলছেন তাদের স্বাভাবিক জীবন। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সারা জীবনের জন্য। এমনই অনেক ঘটনার শিকার হয়েছেন একজন নারী যিনি পেশায়  ব্যারিস্টার। বিয়ের পরের দিন থেকেই তার মোবাইল ফোনে একটি অচেনা নারীর কল আসতে থাকে। রিসিভ করলেই অপর পাশের নারী কণ্ঠটি তার স্বামী সম্পর্কে বিভিন্ন বাজে কথা বলতে থাকেন। জানান তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরানো প্রেমের সম্পর্কের কথা। তাদের সম্পর্কের গভীরতার কথা। সম্পর্ক চলাকালে তারা কোথায় কোথায় গিয়েছেন এবং কি কি করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে থাকেন। তাকে ই-মেইলে পাঠাতে থাকেন তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও। এরকম শুনতে শুনতে একপর্যায়ে ব্যারিস্টার মেয়েটি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি এ কারণে তার ৩ মাসের বাচ্চারও অকাল গর্ভপাত হয়ে যায়। একপর্যায়ে যখন তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তিনি ডিবি পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখার শরণাপন্ন হন। ডিবি পুলিশ মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তাকে আটক করেন।
অনেক সময় দেখা যায়, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ধর্ষণ করে তা ক্যামেরায় ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ওই ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। কখনও কখনও ধর্ষিতার পরিবারের কাছে দাবি করা হয় বড় অংকের টাকা। হুমকি দেয়া হয় টাকা না দিলে ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হবে অনলাইনে। এসব ঘটনায় অনেক নারীই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে অনেক সময় রাষ্ট্রের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের ঘটনাও ঘটে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভুয়া ছবিকে কেন্দ্র করেই রামুতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিল। সম্প্রতি আবু গারিব কারাগারের কিছু ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়ে  বার্মায় মুসলমানদের ওপর অন্যায় নির্যাতন চলছে বলে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়। তাদের এ প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষিপ্ত করে  সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করা। ডিবি পুলিশের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ কাজটি যিনি করেছেন তিনি বাংলাদেশে বসবাসরত একজন বৌদ্ধ। জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, বর্তমানে মানুষ খুব বেশি মাত্রায় প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে। মানবিক সহিষ্ণুতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যে কারণে সাইবার ক্রাইমের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রওশন আরা বলেন, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আর সেটি না হলে অচিরেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আজ যার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রয়েছে কাল সেটি নাও থাকতে পারে। আর তাই ছবি তোলা বা ভিডিও আপলোডের সময় অনেক বেশিমাত্রায় সচেতনতা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষের জীবনে দিন দিন অপসংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করছে। কিশোর-কিশোরীরা শিকার হচ্ছেন প্রতারণামূলক প্রেমের সম্পর্কের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেক্স ওয়েবসাইটগুলো ব্রাউজিংয়ের ফলে তাদের মধ্যে হ্রাস পাচ্ছে নীতি নৈতিকতা। যার ফলে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে সাইবার ক্রাইমসহ নানা অপকর্মে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাইবার ক্রাইমের বিষবাষ্প থেকে রক্ষার এখনই উপযুক্ত সময়। আর এজন্য আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্র সকলেরই সচেতনতা প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.