আলোর নিচে অন্ধকার by আবদুল আলীম

ফারজানা আক্তার শিখা। কাঁঠালবাগান খান হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রাথমিকে ৮ম শ্রেণী চালু করায় এখানেই সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে সে। শিখা যখন অনেক ছোট, তখন তার বাবা মারা যান। এরপর পাবনার গ্রামের বাড়ি থেকে মা তাকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ওঠেন কাওরান বাজার এলাকায়। বুয়ার কাজ করে দিন চলে। মেয়েকেও পড়ালেখা করাতে চান। তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। কারণ এখানে কোন টাকা-পয়সা লাগে না। এখন শিখা বড় হয়েছে। মার পাশাপাশি সেও বুয়ার কাজ করে। একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে শাহেদ আলী। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বাবা রিকশাচালক। কাঁঠালবাগান মহল্লার ঢালে বাসা। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা। কোন মতে টেনেটুনে সংসার চলে তাদের। ছেলেকে ভাল কোন স্কুলে পড়ানোও সম্ভব না। তাই এখানেই পড়ালেখা করতে হয় শাহেদ আলীকে। শুধু শিখা কিংবা শাহেদ নয়, রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শতভাগ শিক্ষার্থী একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের। থাকে বস্তিতে। কারও বাবা তরকারি বিক্রেতা, কেউবা মাছ বিক্রেতা, কেউ আবার রিকশাচালকের ছেলে। গাড়িচালক, ফুসকা বিক্রেতা ও দিনমজুরের ছেলেমেয়েদের আশার আলো রাজধানীর এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বাংলামোটর খোদেজা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাঁঠালবাগান খান হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেজকুনীপাড়া বি কে আফতাব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাঁটাবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নীলক্ষেত প্রাথমিক বিদ্যালয়, নবাবগঞ্জ বড় মসজিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়, আরমানীটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ল, বকশীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডিপিআই প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের মা-বাবার সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা নেই। শিক্ষকরা কেমন পড়ায়, ছেলেমেয়ে কী পড়ে কেউ কোন দিন খোঁজখবর রাখেন না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করেন। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কোন স্কুলের ভবন অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। কোন স্কুলের শ্রেণীকক্ষের সংকট রয়েছে। রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন কাঁঠালবাগান খান হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বসুন্ধরা সিটি মার্কেটের পাশে স্কুলটির অবস্থান হলেও স্কুলে যাওয়ার ভাল কোন রাস্তা নেই। একেবারে নিচু এলাকায় অবস্থিত স্কুলটি। চার তলা ভবনও জরাজীর্ণ। দুটি ভবনের কোথাও কোথাও ভূমিকম্পের সময় ফেটে গেছে। পরে রং করে ফাটা জায়গা ঢেকে দেয়া হয়েছে। কোন রকম ভূমিকম্প হলেই স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী সবাই বাইরে চলে যায়। অনেক ছাত্রছাত্রী সেই দিনের মতো আর স্কুলে ফিরে আসে না। এ স্কুলে পড়ালেখা করে ৮৪২ ছাত্রছাত্রী। এর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৭। একজন শিক্ষকের বিপরীতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২০ জনের ওপরে। রাজধানীতে এমন অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা রয়েছে ১০০ জনের ওপরে। তেজকুনীপড়া বি কে আফতাব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১০১৩। এর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১০। এখানে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ছাত্রছাত্রী পড়ে ১০১ জনের ওপরে। অনেক স্কুলে ছাত্রছাত্রীর তোলনায় শিক্ষক কম থাকায় নিয়মিত ক্লাস চালিয়ে যেতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের।
কোথাও কোথাও আবার শিক্ষক ও জনবল কম থাকায় ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর। সেখানে নতুন করে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করায় তৈরি হয়েছে নতুন সমস্যা। কারণ প্রাথমিকের অনেক শিক্ষক এসএসসি পাস। তাদের জন্য ৮ম শ্রেণীর ক্লাস নেয়া অনেকটা কষ্টকর। এর মধ্যে শিক্ষক না বাড়িয়ে ক্লাস বাড়ানোতে নিয়মিত পাঠদান চালিয়ে যেতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। স্কুলগুলোতে ওয়ার্ড ফুড প্রোগ্রামের আওতায় স্কুল ফিডিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন সকালে প্রথম ক্লাসে জনপ্রতি ছাত্রছাত্রীকে ১ প্যাকেট বিস্কুট দেয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চারা বিস্কুটের লোভে স্কুলে আসে। তবে বড় ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের অনেকে ঝরে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণী থেকেই পড়া ছেড়ে দিয়ে কোন কাজে ঢুকে যায়। এসব ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। বকশীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাধান শিক্ষক মো. শাহাবুদ্দিন শেখ বলেন, গ্রামে যে উপবৃত্তি দেয়া হয়। ঢাকায় ছেলেমেয়েদের জন্য এ ধরনের কোন বৃত্তির ব্যবস্থা নেই। হয়তো সরকার মনে করে রিকশা চালালেই তো স্বাবলম্বী হওয়া যায়। তাই এখানের মানুষেরও টাকার অভাব নেই। এ ছাড়া ঝরে পড়া শিশুদের জন্যও সরকারি কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। শুধু হোমভিজিটের নির্দেশনা দেয়া আছে। কোন ছাত্র বা ছাত্রী যদি টানা ১ সপ্তাহ স্কুলে না আসে, তখন আমরা তার বাসায় যাই। নিজেদের উদ্যোগেই যাই। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে কারণ জানার চেষ্টা করি। আর্থিক কারণে হলে সেখানে আমাদের করার কিছু থাকে না। তবে ভবিষ্যৎ বোঝানোর চেষ্টা করি। আর যদি পড়ালেখার চেয়ে খেলাধুলায় মনোযোগী হয় তখন আমাদের স্কুলে খেলাধুলায় বেশি সময় দেয়ার প্রতি আগ্রহী করার চেষ্টা করি। অন্তত স্কুলে আনার জন্য এটা করি। সরজমিন স্কুল ঘুরে দেখা যায়, স্কুলে ছেলেমেয়েদের জন্য খেলার মাঠের কোন ব্যবস্থা নেই। নিচতলায় গোডাউনের মতো জায়গা আছে। এখানে সকালে অ্যাসেম্বলি করানো হয়। আবার যখন অভিভাবকরা আসে, তাদেরও বসতে দেয়া হয়। তাদের বসার জন্য পাটি বিছিয়ে দেয়া হয়। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীর জন্য যে রুম আছে সেটাকেও খেলার ঘরের মতো করেই সাজানো। ওরা ওখানেই খেলাধুলা করে। এ ছাড়া একটু বৃষ্টিতেই স্কুলের নিচতলায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়। তখন নিচতলায় ক্লাস করা সম্ভব হয় না। আবার অফিসের মধ্যেও পানি প্রবেশ করে। স্কুলে নিচ ও ওপর তলা মিলে টয়লেট রয়েছে ৬টা। এর মধ্যে একটা শিক্ষকরা ব্যবহার করেন। বাকিগুলো ছাত্রছাত্রীরা ব্যবহার করে। এখানে সরকার থেকে দেয়া কোন পানীয়জলের ব্যবস্থা নেই।
শিক্ষার মান ও পরিবেশ: মো. রাসেল। তেজকুনীপাড়া বি কে আফতাব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। ঢাকার বাসা তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায়। বাবা রবিউল ইসলাম পেশায় একজন ‘চেইন কৃপার’। লিফট, বড় এসি বা ভারি কোন জিনিস চেইন দিয়ে টেনে ওপরে ওঠানো তার বাবার কাজ। অল্প আয়ের লোক হওয়ায় ছেলেকে ভাল কোন স্কুলে পড়ানোও সম্ভব না তার বাবার পক্ষে। বাধ্য হয়ে এ স্কুলে পড়তে হয় রাসেলকে। রোববার সকালে সরজমিন স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সকালবেলায় ছোট ক্লাসের বাচ্চাদের ছুটি হয়েছে মাত্র। এখন শিক্ষক-শিক্ষিকারা একটু বিশ্রাম নিয়ে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস শুরু করবেন। এ সুযোগে রাসেল চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ইংরেজি বইয়ে। প্রধান শিক্ষক অফিসিয়াল কাজে বাইরে থাকায় স্কুলের সহকারী শিক্ষক প্রদীপ কুমারকে সঙ্গে নিয়ে জানার চেষ্টা করা হয় পড়ালেখার মান কেমন। রাসেলকে বই দেখে ইংরেজি পড়তে বলা হয়। পড়া শুরু করলে ‘ইয়েস’ শব্দের উচ্চারণ করে ‘ইস’। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে পরের শব্দটা উচ্চারণ করলেও পুরোপুরিই ভুল। পাশের রুমে ‘খ’ শাখাতে নিয়ে যান শিক্ষক প্রদীপ কুমার। সেখানেও এমন অনেককেই পাওয়া যায়। যারা দেখে দেখে রিডিং পড়তে পারে না। এ স্কুলে ১০১৩ ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করে। এর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে মাত্র ১০। ৮ জন নিয়মিত। দুজন সংযুক্তি। মোট ১০ জন। তবে শিক্ষক অনুমোদিত মাত্র ১৪ জন। গত বছর বৃত্তি পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে স্কুলের সহকারী শিক্ষক প্রদীপ কুমার জানান, একজনও বৃত্তি পায়নি। তবে কয়েকজন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
কাঁঠালবাগান খান হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি বড় ফিল্টার রয়েছে। স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর রাহুল জানায়, এ স্কুলের এক সাবেক ছাত্র একটি ফিল্টার কিনে দিয়েছেন। যার থেকে সবাই পানি নিয়ে খেতে পারি। ম্যাডামরা বলেছেন এটা নিরাপদ পানি। এখন তোমরা পানি নিয়ে খেতে পারো। কোন সমস্যা নেই। তবে এ পানিতে গন্ধ বের হয়। মাঝে মাঝে পানিতে ময়লা পড়ে বলে আমরা কেউ এ ফিল্টারের পানি খাই না। বাইরে থেকে আনা পানি খাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিচার্সের (আইইআর)’ শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেক নিম্ন। এখানে পড়ালেখা করে একেবারে নিম্ন শ্রেণীর মানুষের ছেলেমেয়ে। শিক্ষকদের মান ভাল না। এর মধ্যে আবার ৮ম শ্রেণী চালু করা হয়েছে কিছু কিছু স্কুলে। এটা একেবারে বোকামি ছাড়া আর কিছু না।

No comments

Powered by Blogger.