হিন্দু উগ্রবাদ কোথায় নেবে ভারতকে?

ভারত কি বদলে যাচ্ছে? মোদিরা কি ভারতকে বদলে দিতে পারবেন? পারা কি সম্ভব?- এমন সব প্রশ্ন আজ কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। ভারতে উগ্রবাদী হিন্দুরা যতো সক্রিয় হয়ে ওঠেছে প্রতিবাদের মাত্রাও কিন্তু সেই মাত্রাতেই বাড়ছে। ভারতের একটি দৈনিক এই বিষয়টিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে। দৈনিকিটি লিখেছে: গোয়ের্নিকা। উত্তর স্পেনে বাস্কের শহরতলি। তখন গৃহযুদ্ধ চলছে স্পেনে। ১৯৩৭, ছোট্ট শহরটির উপর জার্মান বাহিনীর বেপরোয়া বোমাবর্ষণ। আর ধ্বংসের সেই ভয়াবহ চেহারা ক্যানভাসে তুলে ধরছেন তিনি। শিল্পী পাবলো পিকাসো। কিউবিস্ট ধাঁচে নীল কালো সাদা তেলরঙে ছবি। সাড়ে তিন মিটার দীর্ঘ, ৭.৮মিটার প্রশস্ত ক্যানভাসের চারদিকে ধ্বংসচিত্র। মানুষের চিৎকার। মৃত শিশু কোলে মা। নিরাপরাধ অসহায় মানুষের উপর বর্বরতা। জীবনযন্ত্রণা, অরাজকতা। ছবির কাজ চলার সময় আচমকাই স্টুডিওতে হানা দেয় নাৎসি বাহিনী। ছবি দেখিয়ে তারা প্রশ্ন করে, ‘এটা কি তুমি করেছ?’ শান্ত গলায় ছিটকে আসে উত্তর: ‘না, তোমরা।’ ইতিহাস জানে শিল্পী-সাহিত্যিকরা এভাবেই প্রতিবাদ করেন। এভাবেই প্রতিবাদে সরব হন। যেমন এই মুহূর্তে ভারতে। প্রতিটি মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতাই আজ আক্রান্ত- জীবনের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, কাকে প্রার্থনা করব, কী খাবার খাব, কী পোশাক পরব, কাকে জীবনসঙ্গী করব- দীর্ঘ তালিকা। আক্রমণ কোথাও মৌখিক, কোথাও শারীরিক, আবার কোথাও ধর্ষণ, খুন। নরেন্দ্র দাভোলকার, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গির নৃশংস হত্যা। পরে দাদরিতে মুহম্মদ আখলাখ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের ঘটনায় রুখে দাঁড়িয়েছেন লেখক-সাহিত্যিকরা। সবচেয়ে নৃশংস অধ্যাপক কালবুর্গির হত্যা। আগস্টের ৩০ তারিখ। ভাষা, অঞ্চল-নির্বিশেষে সৃজনশীল লেখকরা জানিয়েছেন জোরালো প্রতিবাদ। ফিরিয়ে দিয়েছেন সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার। পদত্যাগ করেছেন আকাদেমি থেকে। সরব হয়েছেন বহুত্ব ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপর হিন্দুত্ববাদী শক্তির আক্রমণের বিরুদ্ধে। কালবুর্গির হত্যার তদন্ত ঢিমেতালে চলার প্রতিবাদে কন্নড় সাহিত্য পরিষদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেন ছ’জন কন্নড় সাহিত্যিক। বীরান্না মাদিওয়ালার, টি সতীশ জাভারে গৌড়া, সঙ্গমেশ মীনাসিনাকাই, হনুমন্ত হালিগেরি, শ্রীদেবী ভি আলুর এবং চিদানন্দ। সেই শুরু। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণের প্রতিবাদে অধ্যাপক চন্দ্রশেখর পাতিল ফিরিয়ে দেন কর্ণাটক সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান পদ্ম পুরস্কার। তার ঠিক পরেই লেখকদের উপর হামলার ঘটনায় সাহিত্য আকাদেমির নীরবতার প্রতিবাদে পুরস্কার ও অর্থ ফিরিয়ে দেন বিশিষ্ট হিন্দি লেখক উদয় প্রকাশ। এখন প্রতিদিন বাড়ছে এই সংখ্যা। পাঠক, গুণমুগ্ধরা তাদের সাহসী পদক্ষেপকে জানাচ্ছেন অভিনন্দন। প্রতিদিন ভারতের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় শিরোনাম। অভূতপূর্ব। এমনকি প্রাইম টাইমে চ্যানেলে আমন্ত্রণ। প্রতিবাদ এখন একসুরে। হিন্দি, ইংরেজি, পাঞ্জাবি, কন্নড়, কোঙ্কানি, বাংলা, মৈথিলি, মারাঠি, উর্দু- সব ভাষা থেকেই প্রতিবাদ। দেশের সব প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ। লেখক-সাহিত্যিকরা হয় তাদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন, অথবা আকাদেমি থেকে পদত্যাগ করছেন। অথচ, এরাই হলেন ভারতের সেরা প্রতিভা। এখনও পর্যন্ত আকাদেমির সাধারণ পরিষদের ২০ জন সদস্যের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন ৪ জন। দাদরি, মৈনপুরির ঘটনা তাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। গরুর নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে হামলা অব্যাহত। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া জওহরলাল নেহরুর ভাগ্নী, বিজয়ালক্ষী পণ্ডিতের কন্যা নয়নতারা সেহগল কথায়, ‘মানব হত্যা নিষিদ্ধ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে গো-হত্যা।’ চাপের মুখে দাদরির ঘটনার দশদিন পরে মুখ খুললেও এই বর্বরতাকে ‘দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা’ জানাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দাদরির ঘটনা নিয়ে বলেছেন, ‘দুঃখজনক এবং অবাঞ্ছিত, তবে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই।’ সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার ফেরতকে ‘কাগুজে বিদ্রোহ’ বলে কটাক্ষ করেছেন অরুণ জেটলি। তার ব্যাখ্যায়, একটা ‘কৃত্রিম সঙ্কট’ তৈরি করে তার উপর দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কাগুজে বিদ্রোহ তৈরি করা হচ্ছে। লেখক-সাহিত্যিকদের কথা গুরুত্ব দিয়ে সরকারের শোনা উচিত। নাহলে অতীতের মতো পতন অনিবার্য। ইতিহাসে রুখে দাঁড়ায় গোয়ের্নিকা। হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চায় আরএসএস উত্তর প্রদেশের অখিলেশ যাদব ক্যাবিনেটের প্রবীণ মন্ত্রী আজম খান আরএসএস-এর মুখপাত্র পাঞ্চজন্যে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তুমুল সমালোচনা করলেন রোববার। পাঞ্চজন্যে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বেদ মতে, গরু হত্যা পাপ। আজম খানের বক্তব্য, “এই প্রতিবেদন আরএসএস-এর মতাদর্শের প্রতিফলন। তারা মনে করে ভারতবর্ষ একটি হিন্দু রাষ্ট্র। কেউ যদি হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করে, তার বিনিময় প্রাণের মূল্য দিয়ে চোকাতে হবে।” রোববার আজম খান পাঞ্চজন্যে প্রকাশিত- ‘এই উৎপাতের ওপারে’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সমালোচনা করে বলেন, আরএসএস-এর এই মনোভাবের জন্য দেশজুড়ে অনেককে মারা যেতে হচ্ছে ও হবে। পুরস্কার ফেরালেন উর্দু লেখক আকাদেমি পুরস্কার ফেরানোর তালিকায় যুক্ত হলেন আরও এক সাহিত্যিক। রোববার নিজের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ফেরালেন উর্দু কবি মুনাওয়ার রানা। কবি লেখকদের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, “দেশের বর্তমান অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আমি আমার পুরস্কার ফেরাচ্ছি। আগামীদিনেও সরকারি কোনো পুরস্কার গ্রহণ করব না আমি।” দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ে বলতে গিয়ে মুনাওয়ার রানা বলেন, “দেশ জুড়ে কবি লেখকেরা নিজেদের অবস্থান হারিয়ে ফেলেছেন। সাহিত্যিকরা দলীয় নেতা-নেত্রী হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কংগ্রেসপন্থী তো কেউ আবার বিজেপিপন্থী হয়ে পড়ছেন। মুসলিমরা পাকিস্তানপন্থী।” দেশ জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রতিবাদে এখনও পর্যন্ত ২৬ জন সাহিত্যিক আকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়েছেন। চাপে মোদি 'গোমাংস-রাজনীতি'র জেরে বেকায়দায় বিজেপি। দাদরি হত্যা এবং গোমাংস নিয়ে একের পর এক হিংসার ঘটনায় সরব বিরোধীরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিজেপি নেতাদের বিতর্কিত মন্তব্য। যা আরও অস্বস্তি বাড়িয়েছে সরকারের। বিতর্কিত মন্তব্যে পটু এই নেতাদের ডেকে পাঠালেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। রোববার দলীয় হেড কোয়ার্টারে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী মহেশ শর্মা, বিধায়ক সঙ্গীত সোম এবং বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজকে ডেকে পাঠান অমিত শাহ। কোনোরকম বিতর্কিত মন্তব্য না করতে এই নেতা-মন্ত্রীদের সতর্ক করা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে খবর। তিনিই অমিত শাহকে ডেকে এই নেতাদের সতর্ক করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। বৈঠক শেষে বিধায়ক সঙ্গীত সোম সাংবাদিকদের অবশ্য জানান যে দলীয় বিষয়ে আলোচনা করতেই তাদের ডেকে পাঠানো হয়। ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার লিখেছেস,  “মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) বুঝতে পেরেছে, তারা যদি গরুর মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান বজায় রাখে, তাহলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার অজানা বিপদের মুখে পড়তে পারে। এর ফলে মুসলমানরা আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। আরএসএস সেটা বুঝতে পেরে মুখ বন্ধ করেছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা এল কে আদভানি বলেছিলেন, বিজেপি হিন্দুদের সমর্থন নিয়ে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে, কিন্তু মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া দেশ পরিচালনা করা কঠিন। তারপরও ব্যাপারটা শুধু কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। সংঘ পরিবার মুসলমানদের সমর্থন লাভের ব্যাপারটা যদি সত্যিই তীব্রভাবে অনুভব করত, তাহলে তারা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিত। তারা মনে করে, প্রকৃত অর্থে দেশ পরিচালনায় মুসলমানদের ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দিকেই লক্ষ করুন, সেখানে শুধু একজন মুসলমান মন্ত্রী রয়েছেন, তা-ও আবার অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে।” আনন্দবাজার পত্রিকার নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, “বিজেপি চাইছে বিতর্কটা হোক। নেহরুর সময় থেকে তৈরি হওয়া এই যে বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে সংখ্যালঘু তোষণের বদলে এক বিকল্প হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ এসেছে, তাকে এক দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে বিজেপি এগোতে চাইছে। এই মতাদর্শগত সংঘাত এবার ভারতকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে। শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর কি না, তা আমরা জানি না।” এই হতাশা আর শঙ্কা কেবল জয়ন্ত ঘোষালের নয়, অসংখ্য ভারতীয়র। একটি জাতির একটি বড় অংশ যদি হতাশায় ভোগে এবং আরেকটি অংশ যদি ধর্মীয় উগ্রবাদকে আদর্শ মানে তাহলে সেই জাতির কি পরিণতি হয় তার প্রমাণ আফগানিস্তান ও সিরিয়া। ভারত কি সেদিকে যাবে?
ভারতের সাবেক মন্ত্রী এল কে আদবানি ঘনিষ্ঠ বিজেপির প্রাক্তন উপদেষ্টা সুধীন্দ্র কুলকার্নির পর এবার মুখে কালি পড়ল জম্মু-কাশ্মীরের এমপি ইঞ্জিনিয়ার রশিদের মুখে। সোমবার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন চলাকালীন তার মুখে কালি মাখানো ছাড়াও পোড়া মোবিলের কালো তেল ছুড়ে মারা হয়। কেন্দ্রের গোমাংস বিরোধী নীতির বিরুদ্ধাচারণ করে, 'বিফ পার্টি'র আয়োজন করাতেই, বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় রশিদকে। গত ১৫ দিনের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তার ওপর হামলা হল। দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, সাংবাদিক বৈঠকে জম্মু-কাশ্মীরের এই বিধায়ক যখন বক্তব্য পেশ করছিলেন, তখনই হামলা হয়। টিভি চ্যানেলের খবর অনুযায়ী, বিষ্ণু গুপ্তার নেতৃত্বাধীন হিন্দু সেনা এই ঘটনার দায় স্বীকার করে। এর আগে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার মধ্যে বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে। সরকারি সার্কিট হাউজের লনে বিফ পার্টির আয়োজন করাতেই বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাইদ বিধায়কের ওপর এ ধরনের হামলার নিন্দা করেছেন। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহও ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন।
মুখে কালি ও মবিল নিয়েই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন জম্মু-কাশ্মীরের স্বতন্ত্র বিধায়ক প্রকৌশলী রশিদ। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.