ফিলিস্তিনে ইন্তিফাদা : বান্টুস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই by জামাল জুমা

তরুণেরাই হলো এ বিদ্রোহের নায়ক। প্রতিবাদের প্রতিটি ঢেউ তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিরোধের নতুন ভিত তৈরি করছে। গত কয়েক দিনে ফিলিস্তিনজুড়ে প্রথম ইন্তিফাদার (গণঅভ্যুত্থান) চেতনা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তরুণেরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে, ফিলিস্তিনের স্কার্ফ গায়ে জড়িয়ে পাথর নিক্ষেপ করছে। আর ইসরাইলি সৈন্যরা টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং তাজা গুলি ছুড়ে এসব তরুণকে মোকাবেলা করছে। সমগ্র ফিলিস্তিন আজ অবরুদ্ধ। গ্রিনলাইনের উভয় পাশে জেরুসালেম এবং ফিলিস্তিন এলাকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সঙ্ঘাত।
বর্তমান এ প্রতিরোধ সংগ্রামের মূলে রয়েছে সেই চিরাচরিত একই কারণ। ইসরাইলি দখলদারিত্ব, জাতিগত বিদ্বেষ এবং উপনিবেশবাদ ফিলিস্তিনিদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। ফিলিস্তিনি এলাকায় বসতি স্থাপনকারী ইসরাইলিরা সশস্ত্র, সংগঠিত এবং জঙ্গি আদর্শে বিশ্বাসী। তারা ফিলিস্তিনিদের গ্রামে প্রবেশ করে এমনকি ঘরে ঢুকে পর্যন্ত হামলা করছে। গত বছর তরুণ মুহম্মদ আবু খিদিরকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার পর থেকে সম্প্রতি দিমায় দাওয়াব শাহের বাড়িতে আগুন দিয়ে তার মা-বাবা এবং ছোট্ট একটি শিশুকে পুড়িয়ে মারা পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি বর্বর দখলদারিত্ব এবং নিষ্পেষণ বজায় রাখার জন্য ইসরাইলি সৈন্যরা বসতি স্থাপনীকারীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সহায়তা করে যাচ্ছে পশ্চিমতীরে।
ফিলিস্তিনিদের বান্টুস্তানে ঠেলে দেয়া
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পশ্চিমতীরে বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি এলাকা পুনরায় দখল করাসহ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণায় উৎসাহিত হয়েছে বসতি স্থাপনীকারী সন্ত্রাসীরা। অসলো চুক্তি অনুসারে পশ্চিমতীরে ‘এ’ এলাকার বেশির ভাগ জায়গা পুনর্দখলের ঘোষণা দেন নেতানিয়াহু। ‘এ’ এরিয়ায় ব্যাপকভাবে ইসরাইলি সেনা মোতায়েন সেখানকার বসতি স্থাপনকারী বা ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে করা হয়নি। তাদের সবার লক্ষ্য একটি আর তা হলো জেরুসালেম এবং পশ্চিমতীর থেকে যত বেশি সম্ভব ফিলিস্তিনিদের বহিষ্কার করে ইসরাইল সৃষ্ট প্রাচীরঘেরা বান্টুস্তানে (দক্ষিণ আফ্রিকার কালোদের পাঠানোর জন্য তৈরি অচ্ছুত এলাকা) ঠেলে দেয়া। ফিলিস্তিনজুড়ে ইসরাইলি দখলদারিত্ব প্রতিরোধে প্রথম ইন্তিফাদা গড়ে উঠেছিল। আর এখন পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের সব অবকাঠামো ধ্বংস এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আরেক ইন্তিফাদা গড়ে উঠেছে।
একই দখলদারিত্বের লক্ষ্যে তারা গাজায়ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এর আগে। পশ্চিমতীরে জাতিবিদ্বেষী দেয়াল নির্মাণ, বাড়িঘর ধ্বংস, পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করাসহ নানাবিধ বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলিরা।
নির্ভয় তারুণ্য
জাতিগত নিধনের ইসরাইলি এ চক্রান্ত প্রভাবিত করেছে ফিলিস্তিনি তরুণদের। বর্তমানে তাদের যে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তার মূলে রয়েছে ইসরাইলি এ জাতিগত নিধনের ষড়যন্ত্র। অর্থনীতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘর ধ্বংসের ইসরাইলি নীতির বিরুদ্ধে জেরুসালেমের তরুণেরা তাদের মিশন ‘শেকিং অফ’ চালিয়ে যাচ্ছে। এরা কোনো কিছুর ভয়ে ভীত নয়। ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা অথবা পাথর ছোড়ার বিরুদ্ধে ২০ বছরের সাজার নতুন আইন কোনো কিছুর ভয়ে ভীত নয় তারা। মুহম্মদ আবু খিদিরকে পুড়িয়ে হত্যার পর থেকে জেরুসালেমে ইন্তিফাদা চলমান রয়েছে। পশ্চিমতীরের বাকি এলাকায় প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
গত সপ্তাহে সাতজন তরুণ নিহত হয়েছেন এবং আট শতাধিক আহত হয়েছে। গ্রিনলাইনের মধ্যে ফিলিস্তিনিরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ আন্দোলন করে যাচ্ছে। তারা ইসরাইল কর্তৃক চূড়ান্ত বর্ণবাদ, প্রাতিষ্ঠানিক জাতিবিদ্বেষ, জাতিগত নিধনের শিকার। পশ্চিমতীরে ‘এ’ এলাকায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনভাবে চলাচলেরও কোনো অধিকার নেই। তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য। ইসরাইলি জাতিবিনাশী নীতির বিরুদ্ধে সেখানে তাদের ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ (পিএনএ) বা কোনো রাজনৈতিক দল কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছে না। ইসরাইল সৃষ্ট কলোনিতে বসবাসকারী এসব ফিলিস্তিনির আত্মনিয়ন্ত্রণ বা প্রত্যাবর্তন এবং বর্ণবাদের হাত থেকে রক্ষায় তারা কিছুই করতে পারছে না।
ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
ফিলিস্তিনি তরুণদের বর্তমান এ ইন্তিফাদা শুধু ইসরাইলের বিরুদ্ধে নয় বরং ইসরাইলি নিষ্পেষণ থেকে রক্ষায় ব্যর্থ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) বিরুদ্ধেও। ফিলিস্তিন অথরিটিও এ জনরোষ বিষয়ে অবহিত । মাহমুদ আব্বাস জাতিসঙ্ঘের সাম্প্রতিক ভাষণেও এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বান্টুস্তানে ফিলিস্তিনি অথরিটির কর্তৃত্ব এবং অস্তিত্ব বিলীন না করার বিষয়ে তিনি এক ধরনের অনুরোধ জানিয়েছেন ইসরাইল ও তার সমর্থকদের প্রতি। তার ধারণা, ফিলিস্তিনিরা মনে করবে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিন ন্যাশনাল অথরিটি বা পিএনএ।
বান্টুস্তানের ‘এ’ এলাকায় সংহতি স্থাপনের জন্য ইসরাইল এবং পিএনএ’র মধ্যে যে ক্ষমতার ভাগাভাগি হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত টিকবে না। ফিলিস্তিনিদের মাঝে পিএনএকে ন্যূনতম একটি বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করতে হবে। ইসরাইলি বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা এবং স্বাধীনতার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, ইসরাইলের সাথে অর্থনৈতিক চুক্তি বাতিল করা, ইসরাইলকে পুরোপুরি বয়কট এবং অবরোধের ডাক দিতে হবে। যদি এ ন্যূনতম কাজগুলো পিএনএ করতে না পারে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের অভ্যুত্থান ঘটবে। ফিলিস্তিনের সব রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এখন এই অভ্যুত্থানের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। টু স্টেট সল্যুশনের বিষয়ে যারা আশাবাদী ছিলেন, তারা এখন হতাশ। তরুণদের বেকারত্ব এবং হতাশা চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। তারা মর্যাদা চান। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চান।
ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বর্তমান এ অভ্যুত্থান থামাতে পারে কি না তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে অনেকে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিরাপত্তা সংস্থার পক্ষ থেকে পরিস্থিতি শান্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে। নেতানিয়াহু এবং মাহমুদ আব্বাস সঙ্ঘাত বন্ধের আহবান জানিয়েছেন উভয় পক্ষকে। কিন্তু এ আহ্বানের পর পশ্চিমতীরে নতুন করে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে তা ছিল আগের চেয়ে অনেক ব্যাপক। তা ছাড়া আবারো ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
তৃতীয় আরেকটি ইন্তিফাদা ঘটবে কি না সেটা আসল প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্ন হলো, কখন এটা ঘটতে যাচ্ছে? মূল বিষয় হলো ইসরাইলের বসতি স্থাপনকারী কলোনি প্রকল্প। এমনকি যদি ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব নাও থাকে এবং ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা এভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে তাহলে আজ হোক কাল হোক অভ্যুত্থান হবেই।
অনুবাদ : মেহেদি হাসান
লেখক: জামাল জুমা জেরুসালেমে জন্মগ্রহণকারী একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.