তুচ্ছ কারণে বাড়ছে ডিভোর্স

বদলে গেছে সময়। তুচ্ছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ-নানা কারণে ভাঙছে সংসার। বাড়ছে ডিভোর্সের সংখ্যা। আর ডিভোর্সের ক্ষেত্রে এখন এগিয়ে মেয়েরা। এজন্য নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাসহ, ক্যারিয়ার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধকেই মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার দীর্ঘদিনের সম্পর্কটিকে অত্যন্ত পুরনো মনে হচ্ছে নারী পুরুষ উভয়ের কাছেই। যার কারণে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে।
শ্রাবণ ও রাইমার (ছদ্মনাম) ঘটনাটি এমনই। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তারা। কিন্তু বিয়ের পরই সংসারে দেখা দেয় অশান্তি। বিরোধের সূত্রপাত গর্ভের সন্তান নিয়ে। সন্দেহ বাড়তে থাকে দিনকে দিন। একপর্যায়ে একদিন শ্রাবণ রাগের মাথায় রাইমাকে থাপ্পড় দেয়। এ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। শাশুড়ির সঙ্গেও কথাকাটাকাটি হয় শ্রাবণের। শ্রাবণের আচরণ ভাল লাগেনি রাইমার মায়ের। তখন থেকেই মেয়ে রাইমাকে উদ্বুদ্ধ করেন স্বামীকে ডিভোর্স দিতে। রাইমার মা ভাবেন তার মেয়ে বিবিএ পড়ছে, কত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তার। শুধু শুধু বিয়ে নামক সম্পর্কের জালে আটকে থাকার প্রয়োজন কি। আর তাই শ্রাবণের পরিবারের কোন অনুরোধই শোনেননি মা-মেয়ে উভয়েই। শ্রাবণ অনেক চেষ্টা করেও মন গলাতে পারেনি রাইমার। অবশেষে একদিন শ্রাবণের হাতে ডিভোর্সের কাগজ এসে পৌঁছে।
খুলনা থেকে ট্রেনে ঢাকায় ফেরার পথে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে পরিচয় হয় রুমি নামে একটি মেয়ের। রুমির ঢাকায় আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন স্বামীকে ডিভোর্স দিতে যাচ্ছেন। এরপর অশ্রুসিক্ত রুমি জানান তার জীবনের কথা। প্রায় ৬ বছর আগে কথা ফোনে পরিচয় হয় রুমির সঙ্গে রোমেলের। মিষ্টিকণ্ঠী এ মেয়েটিকে বারবার ফোন দিতে থাকে রোমেল। রুমি তখন উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর রোমেল ঢাকার একটি স্বনামধন্য ক্লিনিকের ম্যানেজার। অজানা-অচেনা এ ছেলেটির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হতো রুমির। রোমেল খুব সহজেই রুমির সরল মনে দাগ কাটে। একপর্যায়ে অচেনা ছেলেটির সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে যায় রুমি। রোমেল বেশ কয়েকবার খুলনায় গিয়ে দেখাও করে রুমির সঙ্গে। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের মাঝে বাড়তে থাকে হৃদ্যতা। এরপর রোমেলের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হলে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। রুমি ততদিনে খুলনার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার খাতিরে রুমির পক্ষে সম্ভব হয় না ঢাকায় এসে রোমেলের সঙ্গে সংসার করা। রোমেলই কিছুদিন পরপর খুলনায় গিয়ে রুমিদের বাসায় থাকতেন। ভালই যাচ্ছিল তাদের বৈবাহিক জীবন। কিন্তু বছর ঘুরতেই রুমির চোখে পরে রোমেলের উদাসীন ভাব। ফোন দিলে কথা বলে না, করে ফোন রাখার টালবাহানা। এমনকি রাতে বন্ধ করে রাখে মুঠোফোনটি। রুমি ঢাকায় বেড়াতে আসতে চাইলেও রোমেল তাতে রাজি হয় না। একদিন রুমি স্বামীকে সারপ্রাইজ দিতে কোনকিছু না জানিয়েই ঢাকায় চলে আসে। আসার পর নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যান। স্টেশন থেকে সরাসরি চলে যান রোমেলের বাসায়। সেখানে যাওয়ার পর এক ভদ্রমহিলা বাসার দরজা খুলে দেন। রুমি প্রথমে ভাবেন হয়তো তিনি ভুল ঠিকানায় চলে এসেছেন। আর তাই ঠিকানাটা বারবার মিলিয়ে দেখেন। না ঠিকানা তার ঠিকই আছে। রোমেলের নাম বলতেই ভদ্রমহিলা জানান তিনি রোমেলের স্ত্রী। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যান রুমি। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় রোমেলকেও বাসায় পেয়ে যান। তারপর একে একে জানতে পারেন সবকিছু। রোমেলের দ্বিতীয় স্ত্রী তার সহকর্মী। উভয়ে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের মাঝে মন দেয়া নেয়ার সম্পর্ক। একপর্যায়ে এ সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। রোমেলের দ্বিতীয় স্ত্রী সায়মারও এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তার দুই সন্তান ও স্বামীকে রেখে তিনি রোমেলকে বিয়ে করেছেন। কথাগুলো জানার পর অনেক কষ্ট হতে থাকে রুমির। সে তার মা-বাবাকে জানায় বিষয়টি। তারপর পারিবারিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয় ডিভোর্সের।
একই সঙ্গে পড়াশোনা করতো মিতা আর পাভেল। উভয়েই উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রী। সামান্য চোখাচোখি থেকে একসময় হৃদয় দেয়া নেয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। মিতা আর পাভেলের গভীর সম্পর্ক দেখে অন্যরাও তাদের ঈর্ষা করতেন। একপর্যায়ে দুজনেই আবেগি হয়ে সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। যেহেতু দুজনেই পড়ালেখা করেন তাই উভয় পরিবারের অনুমতি ছাড়াই পালিয়ে বিয়ে করেন তারা। তারপর কেউ যাতে তাদের খুঁজে না পায় সেজন্য কিছুদিন পালিয়ে বেড়ান। কিন্তু দুজনেই বেকার হওয়ায় তাদের কাছে যে অর্থ ছিল তা খুব অল্প দিনেই শেষ হয়ে যায়। এরপর তারা বাধ্য হয়ে পাভেলদের বাসায় গিয়ে ওঠে। পাভেলের মা-বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মিতাকে মেনে নেন। কিন্তু মেনে নিলেও মিতার সঙ্গে কখনও স্বাভাবিক হতে পারতেন না পাভেলের মা। তিনি বিভিন্ন সময় মিতার ওপর মানসিক নির্যাতন চালাতে থাকেন। মিতা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতে থাকে পাভেলের জন্য। মিতা বারবার পাভেলকে বলতে থাকে একটা চাকরি করার জন্য। কিন্তু পাভেলের বিদ্যার যে দৌড় তাতে এই বাজারে তার কোন চাকরি মেলে না। আর এই বেকারত্বই তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। এভাবেই শুরু হয় মিতা আর পাভেলের সম্পর্কের তিক্ততা। একে তো পাভেল বেকার, তার ওপর আবার শাশুড়ির নির্যাতন। একপর্যায়ে মিতা অতিষ্ঠ হয়ে চলে যায় তার মায়ের বাড়ি। তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিতা আর পাভেলের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী ২০০৬ সালে ৮৩টি ডিভোর্স কেস হয়েছে। ২০০৭ সালে হয়েছে ২৫০টি। এর মধ্যে ৬৯টি ডিভোর্স দিয়েছে স্বামী। ১৩১টি দিয়েছে স্ত্রী। ২০০৮ সালে ২৯০টি কেস ফাইল হয়েছে, যার মধ্যে ১০১টি ছেলের আর ১০৫টি মেয়ের। ২০০৯ সালে কেস হয়েছে ২৬৬টি। তার মধ্যে স্বামী করেছেন ৯২টি, স্ত্রী করেছেন ১৭৪টি। ২০১০ সালে ডিভোর্স হয়েছে ২৭২টি। যার মধ্যে স্বামী ৯৬টি, স্ত্রী করেছেন ১৭৬টি। ২০১১ সালে হয়েছে ২৭৩টি। এর মধ্যে স্বামী দিয়েছেন ১০২টি, স্ত্রী দিয়েছেন ১৮৪টি। ২০১২ সালে কেস হয়েছে ২৯১টি। এর মধ্যে স্বামী দিয়েছেন ১০৭টি। স্ত্রী দিয়েছেন ১৮৪টি। ২০১৩ সালে ডিভোর্স হয়েছে ৩১২টি। এর মধ্যে স্বামী দিয়েছেন ৯১টি আর স্ত্রী দিয়েছেন ২২১টি। ২০১৪ সালে ডিভোর্স হয়েছে ৩৭০টি। এর মধ্যে স্বামী দিয়েছেন ১১৮টি, স্ত্রী দিয়েছেন ২৩৪টি। আবার নারী নির্যাতন সেলের অধীনে ২০১০ সালে ডিভোর্স হয়েছে ৮২টি। ২০১১ সালে হয়েছে ৫০টি। ২০১২ সালে হয়েছে ৫১টি। ২০১৩ সালে ডিভোর্স হয়েছে ৩৫টি। জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০১৫ পর্যন্ত ডিভোর্স হয়েছে ১৫টি। দেখা যাচ্ছে, ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন ভয়ঙ্করভাবে বেড়েই চলেছে। এ ব্যাপারে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. রওশন আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, মেয়েরা এখন পড়াশোনা শিখছে, চাকরির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জন্ম নিচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, আর যার জন্য মেয়েদের সহ্য ক্ষমতাও এখন অনেক কমে গেছে। মেয়েরা এখন অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে, তারা তাদের নিজের মতামতের ওপর অটল থাকতে চায়। আর এর ফলেই দেখা দেয় সংঘাত। আবার ছেলেদের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, ছেলেরা চায় তাদের স্ত্রীরা চাকরি করে অর্থ উপার্জন করুক। কিন্তু তারা বাসায় ফিরে আবার স্ত্রীর পরিপূর্ণ সেবা পেতে চান। যখন এরকম না হয় তখনই দেখা দেয় বিপত্তি। আবার অনেক ছেলে স্ত্রীদের অধিক সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। এটিকেও তিনি সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন। সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ডিভোর্সের হার সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী শাহ এহসান হাবিব বলেছেন, বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন আচরণেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। মানুষের সহিষ্ণুতার অভাব ও বিদেশি সিরিয়ালের অনুকরণকে তিনি ডিভোর্সের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিভিন্ন রকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানুষকে কাছে যেমন এনেছে তেমনি আবার দূরেও ঠেলে দিয়েছে। এসবের অতি অধুনিকায়নের কারণে মানুষ তার পরিজন থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ ও চর্চা করতে গিয়ে মানুষের জীবন দিন দিন হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত। তাই পরবর্তীতে তারা ডিভোর্স নামক কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.