মোদির আত্মধ্বংসাত্মক সংস্কার! by কে ইকবাল

নরেন্দ্র মোদির হতাশা বোঝা যায়। তিনি শিশুসুলভ বা ছেলেমি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ব্যক্তিগত, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির সংখ্যা নিরূপণের ক্ষেত্রে দার্শনিকের মতো রাজনৈতিক মালমসলা সংগ্রহ করেন। তার প্রতারণা বা ভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রধান পটভূমি বা ভিত্তি হচ্ছে আরএসএস। মোদির অস্বাভাবিক মুসলিম ও পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের জটিলতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তার উত্তরসূরিরা এই জট খুলে সঙ্কট সমাধানের জন্য হয়তো কিছুটা সময় নিতে পারেন। মোদি পাকিস্তানের ওপর সঙ্ঘাতের ভার ভালোভাবে চাপিয়ে দেবেন।
সন্ত্রাসী পটভূমিকে কাজে লাগানোর কারণে ভদ্রতা, ধৈর্য বা সহিষ্ণুতা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার ক্ষেত্রে মোদির দুর্বলতা রয়েছে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে মোদির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সঙ্ঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও তাতে বাধা না দিয়ে দুষ্কর্মে তিনি সহযোগিতা দিয়েছিলেন। ওই হত্যাকাণ্ডে প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়- যাদের বেশির ভাগ ছিল মুসলমান। ভারতীয় মানবাধিকারকর্মী তিস্তা সেতালভাদ দাঙ্গায় মোদির সম্পৃক্ততার প্রমাণ সংগ্রহ করতে নিজের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন।
ভারতীয় মানবাধিকার কর্মী তিস্তা সেতালভাদ পদ্মশ্রী পুরস্কার গ্রহণকারী একজন নারী। একজন হিন্দু নারী একজন হিন্দু প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি রাজ্যে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ অনুসন্ধান করেছেন, যেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার বেশির ভাগই মুসিলম। দাঙ্গার জন্য মোদিকে হয়তো ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখী হতে হতো। কিন্তু ওই অভিযোগের ব্যাপারে আদালতের প্রসিডিংসের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর সদস্যরা পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সেতালভাদের পরিবারকে হয়রানি ও নাজেহাল করার জন্য তার বাড়িতে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী তল্লাশি অভিযান চালায়। সিবিআই রাজনৈতিক কর্তাদের ইচ্ছাপূরণের জন্য ব্যবহৃত হয় বলে কুখ্যাতি রয়েছে। তবুও ২০০২ সালে সরকারি তত্ত্বাবধানে গুজরাটে তিন দিনব্যাপী মুসলিম গণহত্যা চালানোর সময় মোদি যে বীজ বপন করেছিলেন, তা ২০১৫ সালের আগস্টে এসে সাব-সাম্প্রদায়িক আন্তঃহিন্দু সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। যদিও মোদি মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছেন সেটাকে সামনে নিয়ে আসতে হয়তো উল্লেখযোগ্য সময় লাগতে পারেÑ তবুও পরিণামে তাকে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। মোদি ইতিহাস পুনরায় লেখার ব্যাপারেও ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন- যা হতে পারে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে বিজয় উদযাপনের ঘোষণার চেয়েও বেশি দুর্বোধ্য। যা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য চূড়ান্ত পরাজয়।
ভারতের একজন সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল ভারত কুমার সম্প্রতি সৈন্যসংখ্যার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে থাকা ভারত কেমন করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে অপমানজনক পরাজয় বরণ করেছিল তার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ভারতীয় সেনা বাহিনীর ১৯৬৫ যুগের পেনশনপ্রার্থীরা তাদের পেনশন বহু গুণ বৃদ্ধি না করলে তথাকথিত ‘বিজয় উদযাপন অনুষ্ঠানে’ যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। কী রকম দরকষাকষি!
মোদি ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল প্রক্সিযুদ্ধের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিওইসি) পথে বাধা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করছেন। ভারত দীর্ঘ দিন ধরে সহায়তা, ভ্রমণসুবিধা এবং অন্যভাবে বিদেশে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাকিস্তানবিরোধী ভিত্তিহীন বক্তব্য প্রচারের প্লাটফরম সুবিধা দিয়ে আসছে। তাদের এই প্রচেষ্টা অনেকখানি ব্যর্থ হয়েছে। বেলুচিস্তানে শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারগুলো তখন থেকে ক্ষুব্ধ গ্রুপগুলোর প্রতি সমঝোতামূলক কার্যক্রম শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এখন বিলুপ্ত বালুচ রিপাবলিকান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহামডান বুগতিও খান অব কোল্লাতের নেতৃত্বে প্রধান বালুচ নেতাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। খান অব কুল্লাত নিজেদের ব্যর্থতা ও সংহতি না থাকায় ভাঙন ধরার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। তিনি এখন রাজনীতির মূল ধারায় নিজেদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য আলোচনার টেবিলে চলে এসেছেন। বুগতির সমঝোতা ও সৌহার্দ্যমূলক বক্তব্য বাস্তবধর্মী। মূল ধারার রাজনীতিতে তার ফিরে আসার ইচ্ছা বেলুচিস্তানে অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে নিরুৎসাহিত করেছে। বেলুচিস্তানের পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি ও অগ্রগতি হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক ফেরারি তাদের অস্ত্রসমর্পণ করেছে।
কিশানগঙ্গা হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পের ব্যাপারে নিরপেক্ষ সালিস বা বিচারকের কাছ থেকে অপ্রিয় পুরস্কার পাওয়ার পর মোদি অন্যান্য বিতর্কিত হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টের ব্যাপারে পাকিস্তানের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। পাকিস্তান দেখল যে নয়া দিল্লি ফাঁদে ফেলে প্রজেক্টগুলোর কাজ শেষ করে ফেলার জন্য সময় কাটানোর চেষ্টা করছে। পাকিস্তান বিভিন্ন প্রকল্পের ডিজাইনের ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করল। পাকিস্তানের মতে, এসব নকশার মাধ্যমে যে কাঠামো গড়ে তোলা হবে, সেগুলো পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবহমান পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করবে। এর মাধ্যমে সিন্ধু নদের পানি চুক্তিকে লঙ্ঘন করা হবে। বিষয়টির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাকিস্তান একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগদানের জন্য আইডব্লিউটির গ্রান্টার বিশ্বব্যাংকের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মোদি সার্কপর্যায়ে কয়েকটি দেশে ভারতপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। এরপর তিনি এ অঞ্চলের হারানো সুবিধা ফিরে যাওয়ার জন্য কানেকটিভিটি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাকিস্তানবিরোধী জোটকে নিয়ে দল বাঁধেন। পাকিস্তান যখন তার প্রতিবেশীদের নিয়ে সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী, তখন দেখা যাচ্ছে ভারত পাকিস্তানের অর্থনীতি ও তাদের জনগণের কল্যাণের বিরুদ্ধে ক্ষতি করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে।
ভারত তার প্রতিবেশী ও দূরপ্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার পাকিস্তানবিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের ভূমিকাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার মোদির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সব জায়গায় ব্যর্থ হয়েছেন। পাকিস্তানকে খাঁচায় ভরে রাখার জন্য মোদি যেভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়েছেন, তা তার জন্য বুমেরাং হতে পারে। তার সাম্প্রতিক সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় মোদি পাকিস্তানকে অসহায়ভাবে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেয়ার শর্তে দেশটিকে ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। ইয়েমেনের বিদ্রোহকে শান্ত করার জন্য পাকিস্তানকে সৈন্য প্রেরণে বাধ্য করার পরিবর্তে আরব দেশগুলো পাকিস্তানকে সহায়তা না করলে এবং প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতশূন্য গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে আরবদেশগুলোকে প্রতিরক্ষাসহায়তা দেয়ার প্রস্তাব দেন মোদি। মোদি পাকিস্তান ও আরবদেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের গভীরতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। সৌদি বাদশাহ সালমান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, সৌদি আরব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদির নেতৃত্বে কোনো কিছুকে কখনো অনুমোদন এবং সফল হতে দেবে না।
কাশ্মিরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অধীনে নিয়ে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ভারত দীর্ঘ দিন ধরে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
আইএইচকের সত্যিকারের প্রতিনিধি সর্বদলীয় হুরিয়ত কনফারেন্সের (এপিএইচসি) নেতৃবৃন্দের সাথে পাকিস্তানের প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে বসার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাপর্যায়ের বৈঠক বাতিল ও সাথে সাথে ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘনের ব্যাপারে অটল থাকায় কাশ্মির আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় উঠে আসে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে অনেক বিবৃতি দেন। ওবামার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষ সহকারী পিটার লেভয় ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জম্মু ও কাশ্মির একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড। আমি মনে করি, এ ইস্যু নিয়ে তাদের একত্রে কথা বলা প্রয়োজন। আমি আশা করি, তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন।’
বিশ্বশক্তিগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জম্মু ও কাশ্মির বিরোধের কেন্দ্রীয় পক্ষ হিসেবে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণকে স্বীকৃতি দেয়ার সময় এসেছে। কাশ্মিরিদের বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই সময়ে আমেরিকায় লাখ লাখ লোকের মিছিল (এমএমএম) অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে কাশ্মিরিরা। মিছিল সমাবেশে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাশ্মির বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের একটি সুযোগ আসতে পারে।
আগামী ২৫ অক্টোবর নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। ওটা হবে আমেরিকা প্রবাসী সব কাশ্মিরি ও কাশ্মিরিদের বন্ধুদের প্লাটফর্ম। রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় ও ভাষাগত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে তারা সবাই মিলে ওই প্লাটফর্ম গড়ে তুলবে। আইএইচকে থেকে এপিএইচসি নেতৃবৃন্দকে এই মিছিলে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সৈয়দ আলী শাহ গিলানি, মির ওয়াইজ ওমর ফারুক, মোহাম্মদ ইয়াসিন মালিক এবং শাব্বির আহমদ শাহর ওপর ভারতের পক্ষ থেকে তাদের সফরের ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি আরোপ করা হবে না। মিছিলকারীরা জাতিসঙ্ঘ ও য্ক্তুরাষ্ট্রকে জানাতে চান যে, জম্মু ও কাশ্মিরে বিপুল জনসমর্থন পাওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব আছে। তারা একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান চায়। এই নেতৃত্ব হচ্ছে হুররিয়াত কনফারেন্স। পাকিস্তান সরকার এপিএইচসিকে সমান অংশীদার হিসেবে মেনে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত সরকার তাদেরকে আলোচনার টেবিলে বসতে দেবে, নাকি সংলাপের ব্যাপারে অব্যাহতভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাবে। কাশ্মির সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে তিন স্টেক হোল্ডার পাকিস্তান, ভারত ও কাশ্মিরিদের মধ্যে সংলাপ ও আলোচনা। এই ধরনের আলোচনায় অবশ্যই জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট আয়োজনের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। অপর দিকে বিজেপিকে তার প্রধানমন্ত্রীর পছন্দকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে, যাতে বাজপেয়ির সময়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয়পর্যায়ের সব অর্জন ধ্বংস হয়ে না যায়।
পাকিস্তানের দ্য নেশন পত্রিকা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.