বাংলাদেশ গভীর সঙ্কটে : নিউইয়র্কে শফিক রেহমান

গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে বাংলাদেশ। যেখানে বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। খোঁড়া গণতন্ত্রণের নামে গণমাধ্যমের ওপর চলছে সরকারের সেল্ফ সেন্সরশিপ। প্রথম আলো-ডেইলী স্টার’সহ সবগুলো গণমাধ্যমকে কৌশলেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। গেলো দু’সপ্তাহে এ দু’টি পত্রিকাতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিজ্ঞাপন বন্ধের মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন ও গুম-খুনের রাজনীতি দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসব অভিযোগ করেছেন, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট শফিক রেহমান।
তিনি বলেন, আজকে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ; এটা ডাহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হলে সমুদ্র পথে বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিতে গিয়ে এতগুলো মানুষকে মরতে হতো না। আমি বলবো বাংলাদেশের উন্নয়ন সব ভূমধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরে ডুবে গেছে। বাংলাদেশে সভ্যতা, গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। মধ্যম আয় নয়; সবার আগে দরকার মধ্যম সভ্য দেশ প্রতিষ্ঠা।
নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশন-এনএবিসির দু’দিন ব্যাপী সম্মেলনে কালচারাল শো, ফ্যাশন শো, কাব্য জলশা এবং বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্ক সফরে আসেন প্রখ্যাত কলামিস্ট ও লেখক শফিক রেহমান। রোববার ম্যানহাটনের পেন প্লাজা প্যাভেলিয়নে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণে গণমাধ্যমের ভূমিকা চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে অংশ নিয়ে প্রধান আলোচক হিসেবে দেশের সমসামিয়ক পরিস্থিতি তুলে ধরেন তিনি।
নিজের একটি লেখা এবং সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে শফিক রেহমান বলেন, গণমাধ্যমকে সরকার যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা উদ্বেগজনক। এভাবে চলতে থাকলে দেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। জেল-জুলুম রিমান্ড কালচার দেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিবে না। আজকে যেভাবে বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, তা সবার জানা। কেউ সত্য বলতে পারছে না। মুখ ফুটে কিছু বলার অধিকার নেই। কোন আর্টিকেল পত্রিকা ছাপানো হচ্ছে না। সরকারের সামলোচনা করার দায়ে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দিগন্ত, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ। আমি নিজে ‘মৃত্যুদণ্ড’ নিয়ে একটি বই লিখতে গিয়েও প্রেসের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসব করে সরকার কী উপহার দিয়েছে দেশের মানুষকে? প্রশ্ন রাখেন তিনি। যোগ করে বলেন, আজকে এমন হয়েছে দেশ ছাড়া এবং দেশে প্রবেশ করা দু’টিই কঠিন। অনেক শর্ত ও বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। কোনো বই পুস্তক নিয়ে আসতে পারি না। তবুও অন্যের মারফতে দু’টি সিডি নিয়ে এসছি।
শফিক রেহমান বলেন, পুরো দেশটা একটা চাপা ক্ষোভের মধ্য দিয়ে চলছে। এ সরকারের আমলে প্রায় ২শ’ ৯৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন। উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে আলোচনা করবেন চলবে; কিন্তু খুন-গুমের শিকার সন্তানেরা তাদের পিতার কথা মুখে আনতে পারবে না। এটা কোন নীতি? গুমের শিকার হওয়াদের স্বজনেরা তাদের বুকের কষ্টটুকুও শেয়ার করতে পারছে না। বিশ্ব গুম দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে পারেনি তারা। এক মাস আগে হল বুকিং দিয়েও প্রেস ক্লাবের বর্তমান কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করে। এরই নাম হচ্ছে গণমাধ্যম ও গণতন্ত্রের স্বাধীনতা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আজ বহু গ্রাম পুরুষ শূন্য। এই সরকার হামলা-মালা ও জেল-জুলুম দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে। করবে না কেন? খোদ শেখ হাসিনা এসবের দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন আপনারা বিরোধীদের প্রতিরোধ-প্রতিহত করতে যা প্রয়োজন করুন; দায়-দায়িত্ব আমার। এরপর থেকেই ‘বাংলাদেশ, মামলাদেশ ও পুলিশ-গোপালিশ’ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা নিজেও গুম-খুনের ভয়ে আছেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদেও মন্ত্রী এমপিরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারি জাসদ, অমুক-তমুক বলে বেড়াচ্ছেন। এসব পরিস্থিতি নিয়ে শেখ হাসিনার জীবন শঙ্কার কথাও বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু কেন এমনটি হবে?
সাংবাদিক মঈনুদ্দিন নাসেরের সঞ্চালনায় এতে তরুণ প্যানেলিস্ট হিসেবে অংশ নেন বিএফউইজের দপ্তর সম্পাদক ও একুশে টেলিভিশনের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি ইমরান আনসারী, মূলধারার গণমাধ্যম এবিসি মায়ামির প্রডিউসার অনিভা জামান, সাংবাদিক মনোয়ারুল ইসলাম ও সাপ্তাহিক বর্ণমালার সম্পাদক ও ৭১ টেলিভিশনের যুক্তরাষ্ট্র ব্যুরো চীফ মাহফুজুর রহমান।
অনিভা জামান বলেন, আমার আমেরিকাতে জন্ম। আমি একজন গণমাধ্যম কর্মী। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের টিভিতে যেসব খুন-রক্তপাত দেখানো হচ্ছে তা দেখে বিস্মিত পুরো বিশ্ব। আমার আম্মু মাঝে মধ্যে বলেন এসব দেখাচ্ছে কেন; ভয় লাগছে। আমি বলি দেখানো উচিত। আরো অনেক ঘটনা আছে, এসব প্রকাশ করাই হচ্ছে স্বাধীনতা। অনেক সাংবাদিক সত্য বলে খুনের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশে। এটা ঠিক না। চুপ করে থাকা যাবে না। সত্য প্রকাশ করতে হবে।
ইমরান আনসারী বলেন, আজকে বাংলাদেশে যে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তা প্রমাণিত। সরকার সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী। যার মাধ্যমে সরকারের সমালোচনাকারিদের চাইলেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জড়ানো যাবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রেভ্যুলেশনকে রোধ ও নিয়ন্ত্রণে সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা নিয়ে ইতোমধ্যেই সমালোচনা উঠেছে। যা গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম কারো জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুক ও ইউটিউব তো রয়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণেও উঠে পড়ে লেগেছে সরকার। এসময় তিনি একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম ও বিএফইউজের সভাপতি শওকত মাহমুদ সহ সব কারাবন্দী গণমাধ্যম কর্মীদের মুক্তির দাবি জানান। গণতন্ত্রের স্বার্থে বন্ধ গণমাধ্যমগুলো অবিলম্বে খুলে দেয়ারও দাবি জানান তিনি।
মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রাতিক ধারা অব্যাহত রাখতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।
মাহফুজুর রহমান বলেন, আজকে শফিক রেহমান যেসব কথা বলেছেন তা সাম্প্রতিক। কিন্তু গণমাধ্যমের এই দুর্দশার জন্য দায়ী কারা। দ্বিধাবিভক্তির সাংবাদিকরা। সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে অতীত বিএনপির আমলে। সেসময়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে পুলিশ প্রবেশ করে সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা বিষয়ই আজকের এই পরিণতি।
শেষে উপস্থিত কয়েকজনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন শফিক রেহমান। তিনি বলেন, পুরো বিশ্ববাসী, ডিপ্লোম্যাট সবাই জানে এ সরকার অবৈধ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বৈধতা কেউ দেয়নি। তাই আমি বলবো, অবিলম্বে সরকার জেল-জুলুম ও গুম-খুন বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় দেশ ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে চলে যাবে। আমি এটা নিশ্চিয়তা দিতে পারি বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে। কারণ বেগম জিয়াকে আমি ভালো করে জানি। তিনি প্রতিহিংসা পরায়ন নন।

No comments

Powered by Blogger.