এক জাহিদের অনেক ‘কীর্তি’ by তানভীর হাসান

মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জমি দখল, সন্ত্রাস—সবই চলছে তাঁর নেতৃত্বে। ধলেশ্বরীর তীর ও রাস্তা দখল করে চলছে তাঁর ইট ও বালুর ব্যবসা। মালবাহী জাহাজের খোঁচায় ব্লক সরে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে মুন্সিগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধও।
তিনি জাহিদ হাসান। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বছরের পর বছর এসব ঘটলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। এতে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জাহিদের বিরুদ্ধে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় যুবদল নেতা মুক্তার হোসেন হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। ২০০১ সালে মুক্তারকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জাহিদের বিরুদ্ধে মামলা আরও বেশি হবে বলে স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি।
মুন্সিগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ ইমদাদ হোসাইন জানান, বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে, এমন মামলার মধ্যে সদর থানায় ২০০৫ সালের একটি অস্ত্র মামলা ও ২০১৩ সালের একটি মাদক মামলা রয়েছে জাহিদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে হাটলক্ষ্মীগঞ্জে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায়ও তাঁর জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
প্রায় চার মাস আগের ঘটনা। নদীর তীরের নৌযান থেকে চাঁদাবাজি ও বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাহিদের লোকজনের সঙ্গে হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকায় পৌর কাউন্সিলর মকবুল হোসেনের লোকজনের গোলাগুলি হয়। এ সময় এক পথচারী, এক রিকশাচালকসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। ভয়ে তাঁরা কেউ মামলা করেননি। পরে পুলিশ মামলা করে।
পঞ্চসার ইউনিয়নের নয়াগাঁও গ্রামে জাহিদের বাড়ি। রাজনীতিতে আসার আগে ১৯৯৬ সালেও তিনি দরজির কাজ করতেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁর ভাগ্য বদলায়। আগে তাঁদের দোচালা টিনের ঘর ছিল। এখন সেখানে তিনতলা বাড়ি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে তাঁর একাধিক বাড়ি রয়েছে বলে এলাকাবাসীর কয়েকজন জানান।
নয়াগাঁওয়ে চাঁদতারা মসজিদসংলগ্ন এলাকায় শহররক্ষা বাঁধ ঘেঁষে একটি টং দোকান বসিয়েছেন জাহিদ। সেখানে থেকে তিনি ইট ও বালুর ব্যবসা করছেন। বাঁধের পূর্ব পাশ দিয়ে গেছে ঢাকা-মুক্তারপুর-নয়াগাঁও-মুন্সিগঞ্জ সড়ক। সড়ক ও বাঁধের মধ্যবর্তী অংশে নয়াগাঁও অংশে বিশাল জায়গা দখল করে চলছে এ ব্যবসা। সেখানে সড়কের জমি দখল করে পঞ্চসার ইউনিয়ন যুবলীগের কার্যালয়ও নির্মাণ করেছেন জাহিদ।
জাহিদের ইট ও বালুর ব্যবসার কারণে এখানে নিয়মিত নৌযান আসায় শহররক্ষা বাঁধের ব্লক ধসে পড়ছে। বালুর কারণে আশপাশের পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কিন্তু এলাকাবাসী এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইউনিয়নের বণিক্যপাড়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশাল একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে নিজের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন জাহিদ। তাতে লেখা, ‘এই জমির মালিক জাহিদ গং’। চার-পাঁচ মাস আগে পুকুরটি ভরাট করা হয় বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসী জানান, স্বাধীনতার আগেও এই সম্পত্তির মালিক ছিল হিন্দুরা। স্বাধীনতার পর তারা ভারতে চলে যায়। তখন তাদের কাছ থেকে স্থানীয় আবু তাহেরের বাবা আলী মিয়াসহ ওয়ারিশরা ওই জমি কিনে নেন। পুকুরটিও তাঁদের ছিল। কিন্তু এখন জাহিদ গংরা সেই পুকুর জোর করে ভরাট করে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করছেন।
জমির মালিক আবু তাহের বলেন, জাহিদের জমি দখলের প্রতিবাদ করায় তাঁদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে থানা-পুলিশ করার পরও কিছু হচ্ছে না। পরে তাঁরা আদালতে মামলা করেন।
এসব বিষয়ে কথা বলতে যুবলীগের নেতা জাহিদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বণিক্যপাড়ার ওই সম্পত্তি আমি এক মালিকের কাছে থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েছি। ওই মালিক আর আমি অংশীদার। আমার জমি আমি ভরাট করমু, এটা আপনে দেখার কে?’ তিনি একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনে লেইখ্যা কিছু করতে পারবেন না। এমন অনেক সাংবাদিক দেখছি। লেইখ্যা পত্রিকার পাতা ভইরালান, কিছুই হইব না। বরং আমি নিজেই কইয়া দেই, আমার বিরুদ্ধে আপনি কী লিখবেন।’
জাহিদকে ইউনিয়ন যুবলীগের স্বঘোষিত সভাপতি আখ্যায়িত করে সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বাদল রহমান বলেন, ‘জাহিদরা মিলে যে কমিটি গঠন করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে, সেটাকে আমরা এখনো অনুমোদন করিনি।’ জাহিদের দলীয় কার্যালয় স্থাপন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দলীয় কার্যালয় তৈরিতে তো কোনো বাধা নেই। এটা দলের যে কেউ নির্মাণ করতে পারেন। যারা এই জেলার আলো-বাতাস গ্রহণ করে বড় হয়েছে, তাদেরকে জাহিদ সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।’

No comments

Powered by Blogger.