ভয়ংকর বার্তা দিল আইএস! কুয়েতে হামলাকারী সৌদি নাগরিক, তিউনিসিয়া ছাড়ছে পর্যটকেরা

আবু সুলেইমান আল-মুয়াহিদ
তিউনিসিয়ায় জঙ্গি হামলার নিন্দা জানিয়ে উপকূলীয় সুস শহরে গতকাল রোববার সমাবেশ হয়েছে। কুয়েতের শিয়া মসজিদে হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করেছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ। আর ফ্রান্সের লিয়ঁ এলাকার এক ব্যক্তির শিরশ্ছেদের নৃশংস ছবি মুঠোফোনের মাধ্যমে কানাডায় পাঠানোর ঘটনায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ওই তিন দেশেই গত শুক্রবার সন্ত্রাসী হামলা হয়। খবর এএফপি, বিবিসি ও আল-জাজিরার।
তিউনিসিয়ার পর্যটন শহর সুসের জনসাধারণ সেখানকার একটি হোটেলে জঙ্গি হামলায় ৩৮ জনকে হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে গতকাল সমাবেশ করেছে। গত শুক্রবারের ওই হামলায় নিহত বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন ব্রিটিশ নাগরিক। সিরিয়া ও ইরাকভিত্তিক সুন্নি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
কুয়েতের মসজিদে হামলাকারী সৌদি নাগরিক: কুয়েত সিটির একটি শিয়া মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি সৌদি আরবের নাগরিক, নাম আবু সুলেইমান আল-মুয়াহিদ। কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল জানায়, সুলেইমান শুক্রবার ভোরে কুয়েত বিমানবন্দর দিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেন। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত ও ২২৭ জন আহত হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে হামলাকারীর গাড়িচালকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সালহির স্বীকারোক্তি: ফ্রান্সে শুক্রবার শিরশ্ছেদের ঘটনায় জড়িত বলে সন্দেহভাজন ইয়াসিন সালহি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অ্যারভে করনারাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। সালহি জানান, তাঁদের মধ্যে কয়েকদিন আগে ঝগড়া হয়েছিল। সালহি শিরশ্ছেদের ওই ঘটনার একটি ছবি (সেলফি) কানাডার একটি মুঠোফোন নাম্বারে পাঠান বলে গতকাল খবর প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, বেশ কয়েক ঘণ্টা নীরব থাকার পর ওই হামলা সম্পর্কে তথ্য দিতে শুরু করেছেন ৩৫ বছর বয়সী সালহি।
ভয়ংকর বার্তা দিল আইএস! -গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ
ভিন্ন মহাদেশের তিন ভিন্ন দেশে হামলা। কিন্তু সন্দেহের তির একদিকেই। গত শুক্রবারের ওই হামলার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দিকে যায়। তিউনিসিয়া, কুয়েত ও ফ্রান্সে চালানো এসব হামলার কৌশল আইএসের হামলার কৌশলেরই প্রতিধ্বনি।
এর মধ্যে কুয়েতে শিয়া মসজিদে চালানো আত্মঘাতী হামলার দায় ইতিমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছে আইএসের সহযোগী সংগঠন বলে পরিচয় দেওয়া নাজাদ প্রভিন্স। তিউনিসিয়ায় হামলার দায়ও স্বীকার করেছে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক এই জঙ্গি সংগঠনটি। ফ্রান্সে হামলায়ও আইএসের জড়িত থাকার জোরদার ইঙ্গিত মিলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান হত্যার সঙ্গে মুসলমানরাই জড়িত। সুন্নি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ উপসাগরীয় দেশ কুয়েতের শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী হামলায় সেটাই হয়েছে। এই হামলা ওই অঞ্চলে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক সহিংসতারই অংশ। এমন সহিংসতা ওই অঞ্চলে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এবং তা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সুন্নিপন্থী আইএস শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ১০ বছর বা তারও বেশি সময় আগে ইরাকে উৎপত্তি হওয়া জঙ্গি এই সংগঠনটি আবারও ইরাকে ফিরেছে, যা সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে আরও মুসলমান হত্যার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।
খাঁ খাঁ করছে তিউনিসিয়ার ইমপেরিয়াল মারহাবা
হোটেলের কাছের সৈকত। শোকসন্তপ্ত মানুষ একে
অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। গত শুক্রবার ওই হোটেলে হামলা
চালিয়ে জঙ্গিরা ৩৮ জনকে হত্যা করে l ছবি: এএফপি
আরব বসন্তের সূতিকাগার বলে পরিচিত তিউনিসিয়ায় হামলা চালানোর মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন পশ্চিমা পর্যটকেরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হোটেল এবং অবকাশযাপন কেন্দ্রগুলোতে বারবার হামলা হচ্ছে। ইসলামি বিশ্বে পশ্চিমাদের উপস্থিতি স্পষ্টভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ। হোটেলে হামলা হলে তা সারা বিশ্বের মনোযোগ পায়, হামলাকারী গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পায় ও স্থানীয় পর্যটনশিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে। এই হামলার প্রধান সন্দেহভাজনেরা স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর একাংশের সদস্য হয়ে থাকতে পারেন কিংবা প্রতিবেশী লিবিয়ার কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য অথবা আইএসের অনুগত গোষ্ঠীর সদস্য হতে পারেন। গত মার্চে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসের বিখ্যাত বোরদো জাতীয় জাদুঘরে সন্ত্রাসী হামলায় ২১ জন বিদেশি পর্যটক এবং এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। এরপর আবার এই হামলায় দেশটির পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তিউনিসভিত্তিক উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক বিশ্লেষক মনিকা মার্কস বলেন, গত মার্চের চেয়ে গত শুক্রবারের হামলা তিউনিসিয়ার পর্যটনশিল্পের বেশি ক্ষতি করবে। কারণ, যে পর্যটকেরা তিউনিসিয়া আসেন তাঁরা শুধু বোরদো জাদুঘর দেখতেই আসেন না। অনেকেই, বিশেষ করে জার্মান ও ব্রিটিশ পর্যটকেরা সৈকতে সময় কাটিয়ে ভিটামিন ডি সংগ্রহ করতে চান।
তৃতীয় হামলা হয়েছে ফ্রান্সে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারখানায়। সন্দেহভাজন হামলাকারীর বয়স ২২ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। যিনি বিদেশে জন্মগ্রহণের পর ফ্রান্সে এসে নাগরিকত্ব পেয়েছেন কিংবা তাঁর বাবা-মা আলজেরিয়া বা মরক্কো থেকে অভিবাসী হিসেবে ফ্রান্সে ঢুকেছেন। এ ধরনের হামলাকারীর সঙ্গে বিদেশের কোনো গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা থাকে; আবার কেউ কেউ একাই হামলায় অংশ নেয়।
এটাও সম্ভব যে, সমন্বয়ের মাধ্যমে ওই তিনটি হামলা চালানো হয়েছে, যা আইএসের নতুন কৌশলগত চিন্তাভাবনা ও সামর্থ্যের ইঙ্গিত দেয়। যদি এটা তারা না-ও করে থাকে, তাহলেও এর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীরা শক্তিশালী বার্তা দিল যে, তারা বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে সক্ষম।
ফ্রান্সসহ ইউরোপে কড়া নিরাপত্তা, কুয়েতে জাতীয় শোক- তিউনিসিয়া ছাড়ছে পর্যটকেরা
তিউনিসিয়ায় গত শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলায় ৩৮ জনকে হত্যার ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের দমনে দেশটির সরকার কঠোর অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার পর্যটক তিউনিসিয়া ছেড়ে গেছেন।
কুয়েতের একটি শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী হামলায় একই দিনে নিহত ২৭ জনের স্মরণে গতকাল শনিবার জাতীয় শোক পালিত হয়েছে। আর ফ্রান্সের একটি কারখানায় শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির পাশাপাশি ইউরোপের কয়েকটি দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। খবর এএফপি, বিবিসি ও রয়টার্সের।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) তিউনিসিয়া ও কুয়েতের দুটি হামলার দায় স্বীকার করেছে। তিউনিসিয়ায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ব্রিটিশ নাগরিক।
তিউনিসিয়া: শুক্রবারের হামলার পর আতঙ্কিত হাজারো পর্যটক গতকাল শনিবার তিউনিসিয়া ছেড়ে গেছেন। হামলায় জড়িত অপরাধীদের দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। প্রধানমন্ত্রী হাবিব এসিদ গতকাল বলেন, তিউনিসিয়ার বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র ও অবকাশযাপন কেন্দ্রে সেনা মোতায়েন করা হবে। আর সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ৮০টি মসজিদ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
তিউনিসিয়ায় নিহত ৩৮ জনের মধ্যে ব্রিটিশ পর্যটক ছাড়াও জার্মানি, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড ও ফ্রান্সের নাগরিকেরাও রয়েছেন। হামলাকারী বন্দুকধারীর নাম আবু ইয়াহিয়া আল-কায়রাওয়ানি। তাঁর মরদেহ ঘটনাস্থলের কাছ থেকেই উদ্ধার করা হয়।
কুয়েত: কুয়েত সিটির শিয়া মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী হামলায় ২৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দেশটিতে গতকাল জাতীয় পর্যায়ে শোক পালন করা হয়। কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমদ আল-সাবাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ওই হামলাকে তাঁর দেশের জাতীয় ঐক্যের ওপর আঘাতের অপচেষ্টা বলে মন্তব্য করেন।
ফ্রান্স: দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় লিয়ঁ শহরের কাছাকাছি মার্কিন মালিকানাধীন একটি রাসায়নিক কারখানায় শুক্রবারের হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো জিহাদি সংগঠন দায় স্বীকার করেনি।
যুক্তরাজ্যে শোকের ছায়া: তিউনিসিয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় যুক্তরাজ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.